২৪-শে সেপ্টেম্বর প্রায় এক বছর মহাকাশ ভ্রমণের পর ISRO-র মঙ্গলযান তার নির্দিষ্ট কক্ষে গ্যাঁট হয়ে বসলো। বা পাক খেতে শুরু করলো। এরপর কি ? যেহেতু এই মিশনটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পারি কিনা দেখা যাক, যুদ্ধ বেশ কিছুটা নেমে গেছে। প্রমাণ হয়ে গেছে, আমাদেরও প্রযুক্তি আছে গ্রহ থেকে গ্রহে হাত বাড়ানোর বা সেখানকার হাল-হকিকত সরাসরি প্রত্যক্ষ করার।
কিন্তু, মঙ্গলগ্রহের হাল-হকিকত সম্বন্ধে ঠিক কি জানতে চাই আমরা ? মঙ্গলযানে চড়ে যেসব যন্ত্রপাতি পাড়ি দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে একটা মিথেন সেন্সর। মঙ্গলগ্রহের বায়ুমন্ডলে মিথেন গ্যাস আছে কিনা আর থাকলে কি তার বিন্যাস, তাই মাপবে এই সেন্সরটা। মঙ্গলযান যেহেতু অল্প খরচে বানানো, তাই তার ভার বহনের ক্ষমতা (যাকে বলে payload), সেটাও সীমিত। ভেবেচিন্তে ওই সীমিত payload-এর মধ্যে ঠিক যন্ত্রগুলি বাছতে হয়েছে। এতকিছু থাকতে মিথেন সেন্সর কেন ?
এর উত্তর জানতে হলে তাকাতে হবে আমরা যে গ্রহটিতে বাস করছি, তার দিকে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে মিথেনের পরিমাণ খুবই সামান্য, এটা বললেও বাড়িয়ে বলা হবে। ১০০ কোটি ভাগে ১৮০০ ভাগ: তাও এটা ২০১১-র হিসেব, যখন বায়ুমন্ডলে মিথেন সবচেয়ে বেশী ঢালছি আমরা। কিন্তু মানুষের কীর্তি বাদ দিলে বাকি মিথেনটার প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ আসে জৈব ক্রিয়া থেকে। একপ্রকার জীবাণু আছে, যারা অক্সিজেনের সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় না। এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বদলে মিথেন ছাড়ে। এদের মূলত জলাভূমিতে পাওয়া যায় (আমাদের পরিপাক নালীর মধ্যেও পাওয়া যায়)। এরা ব্যাকটেরিয়াও নয়, তার থেকে উন্নত জীবজগত-ও নয়, সম্পূর্ণ একটা তৃতীয় দল (archaea)। বায়ুমন্ডলে বেশিরভাগ মিথেনের জন্য এরাই দায়ী। অতএব মঙ্গলগ্রহে যদি মিথেন পাওয়া যায়, তাহলে সেখানেও কি… ?
২০০৩-৪ সালে যখন প্রথম মিথেনের আভাস পাওয়া গেল, তর্ক সেই দিকেই এগোচ্ছিল। এই তর্কের আরেকটা মজার লেজুড় আছে। মিথেনের ফোটোকেমিকাল আয়ু মোটামুটি ৩০০ বছর। অর্থাৎ ৩০০ বছরের মধ্যে সুর্যের রশ্মিতে ভেঙ্গে যায় মিথেন অণুগুলি। তার মানে, এখন যদি মঙ্গলগ্রহে মিথেন পাওয়া যায়, গত ৩০০ বছরের মধ্যেই কোথাও প্রাণ টিমটিম করছিল, এমনটা ভাবা খুব ভুল হবে কি ? এই একটা জিনিস ভেবেই লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার কথা। মাত্র ৩০০ বছর !
২০০৩-৪-এর মিথেন সনাক্তকরণটা খুব স্পষ্ট ছিল না। Mars Odyssey বা Mars Express কেউই মিথেন খুঁজছিল না ঠিক। তাই তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে পরোক্ষভাবে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল মিথেনের। স্পষ্টভাবে বলা যাচ্ছিল না যে মিথেন-ই।
২০০৩-২০০৬-এর মধ্যে পৃথিবীতে বসে যেসব টেলিস্কোপ তাকিয়ে ছিল মঙ্গলগ্রহের দিকে, সেগুলোর উপর spectroscopy করা হলো। Spectroscopy-তে আলোকে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গে ভেঙ্গে ফেলা হয়। এবং ভেঙ্গে ফেলে দেখা হয়, সবকটা দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ-ই আশানুরূপ পরিমাণে আছে কিনা। কোনো তরঙ্গের অনুপস্থিতি বা পরিমাণের হেরফের থেকে খুব স্পষ্টভাবে একটি বিশেষ অণুকে সনাক্ত করা যায়, কারণ সেই দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ সেই বিশেষ অণুটাই শোষণ করতে পারে। তো মঙ্গলগ্রহ থেকে আসা আলোর উপর এই spectroscopy করে আবার মিথেন পাওয়া গেল। শুধু তাই নয়, দেখা গেল মিথেনের বিন্যাসটা সব জায়গায় এক নয়। কিছু জায়গায় জমাট, কিছু ফিকে।
আরেকটা লক্ষ্য করার বিষয় ছিল। সনাক্তকরণ পদ্ধতি যত সূক্ষ্ম হতে লাগলো, মিথেনের গড় পরিমাণ কত, সেই আন্দাজটাও নিচের দিকে নামতে লাগলো। এই নামার শেষ হলো Mars Curiosity দিয়ে। ২০১২ সালে Curiosity সোজা মঙ্গলগ্রহের উপর নেমে পড়লো। আর তাতে ছিল একটি Tunable Laser Spectrometer। আলোকে যত সূক্ষ্মভাবে তার তরঙ্গে ভাঙ্গা যায়, তত নিশ্চিতভাবে একটা অণুকে সনাক্ত করা যায়। Curiosity-র মধ্যে যে Spectrometer-টি ছিল, এই ব্যাপারে সে তার পূর্বসুরীদের অনেক পিছনে ফেলে দেয়।
আর তাতে দেখা গেল, মঙ্গলগ্রহে মিথেন নেই। এর আগেই শোরগোল উঠছিল যে পৃথিবীতে বসে যে মিথেন সনাক্তকরণগুলো হয়েছে, তাতে গোলমাল আছে। কারণ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মিথেন ঘেঁটে দিচ্ছে মঙ্গলগ্রহ থেকে আসা আলোটাকে। NASA-ও Curiosity-র পরিমাপের পর মানতে শুরু করলো যে হ্যাঁ, সেটা হতে পারে।
তবে Curiosity-ই শেষ কথা নয়। সে মিথেন মাপছিল নিচুতলার বায়ুমন্ডল থেকে, তাও একটা সীমিত চত্বরের মধ্যে। আগেই বলেছি, মিথেনের বিন্যাস সব জায়গায় এক নয়। হয়ত মিথেনের সূত্রের কাছকাছি থাকা প্রয়োজন। এমনও তো হতে পারে যে মিথেন যেটা তৈরী হচ্ছে, সে তার পুরো আয়ু থাকছে না। সুর্যের রশ্মি নয়, অন্য কোনো ক্রিয়ার ফলে সেটা অল্প সময়েই ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই সূত্রের কাছাকাছি না থাকলে তাকে ধরা মুস্কিল। সেসব ক্রিয়া কেমন হতে পারে, তার সম্বন্ধেও কিছু ধারণা আছে বিজ্ঞানীদের।
মিথেনের গল্পটাতে আরও প্যাঁচ আছে। শুধু জৈব ক্রিয়াই নয়, আরও অনেকভাবে তৈরী হতে পারে মিথেন। যেমন আগ্নেয়গিরির ভিতর থেকে। তবে সেই সম্ভাবনাটা বাতিল হয়ে গেছে কারণ আগ্নেয়গিরি থাকলে যতটা দেখা গেছে, তার থেকে অনেক বেশি মিথেন পাওয়া উচিত ছিল। বা তার আনুসঙ্গিক সালফার ডাইঅক্সাইড-ও পাওয়া উচিত ছিল। যেমন পৃথিবীতে পাওয়া যায়, আগ্নেয়গিরি চত্বরে। আরো একটা সম্ভাবনা রয়েছে: মঙ্গলগ্রহে অলিভাইন নামে একটা খনিজ আছে যেটা সার্পেনটাইন নামে আরেকটা খনিজে রুপান্তরিত হয় এবং সাথেসাথে মিথেন ছাড়ে। তবে মজা হলো, সেই ক্রিয়ার জন্য চাই জল। হয়ত জৈব ক্রিয়া নয়, মিথেনের উপস্থিতি জলের প্রমাণ দেয়!
এই ডামাডোলের মধ্যে ভারত পাঠালো মঙ্গলযান। ভিতরে মিথেন সেন্সর। সারা বিশ্বের চোখ এখন ওইদিকে: এবার হয়ত সমস্যাটার একটা এসপার ওসপার হতে পারে।