মানব সভ্যতার ইতিহাস বলে যে আমাদের আদি প্রজন্মের মানুষ ছিল যাযাবর। তারা ঘুরে ঘুরে শিকার করে, গাছের ফলমূল সংগ্রহ করে খিদে মেটাতো, আর তাই খাবারের খোঁজেই যাযাবরের জীবন কাটাতে হত তাদের। তারপর একসময় মানুষ আবিষ্কার করল যে তারা চাইলে কিছু বীজ রোপণ করে গাছ তৈরী করতে পারে, আর সেই গাছ দিতে পারে শস্য, ফল। চাষের জন্ম হল। মানুষ ঘর বাঁধতে শিখল। গড়ে উঠতে শুরু করল সমাজ, সভ্যতা। ভয় নেই, মানব সভ্যতার চেনা ইতিহাস নিয়ে গল্প করতে আমি বসিনি। আমি বলব আর এক সভ্যতার কথা। সভ্যতা বলাটা ঠিক হলনা অবশ্য, পিঁপড়েদের সমাজ আছে, সভ্যতা নেই – তাই বলা উচিত সমাজব্যবস্থা। কিন্তু পিঁপড়েদের গল্পে মানুষ ঢুকে পড়ল কেন ? কারণটা শুনতে সহজ, হজম করতে যদিও একটু কঠিন হতে পারে – আমি যাদের গল্প বলব, তারা চাষী পিঁপড়ে।
পিঁপড়েরা যে দল বেঁধে থাকে, মাটির নীচের বা গাছের খোঁদলের বাসায়, সে কথা অনেকেরই জানা। আবার তাদের বাসার বেশীর ভাগ অধিবাসীই যে শ্রমিক, আর মোটে একজন ( বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অল্প কয়েকজন ) রাণী, তা অনেকেরই অজানা নয়। এই শ্রমিক পিঁপড়েরা বাসা বানায়, সেই বাসা পরিষ্কার রাখে, মেরামত করে, খাবার আনে, রাণী আর তার ছানাপোনাদের খাওয়ায়, বাসা পাহারা দেয়, এমনকি দরকার পড়লে বাসাবদল-ও করে, আর তখন নতুন বাসার জন্য সুবিধেজনক জায়গা খোঁজা থেকে শুরু করে বাসা তৈরী করে রাণীর হাজার হাজার কুঁচোকাঁচাকে ঘাড়ে করে বয়ে নতুন বাসায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু করতে হয় তাদেরই। এককথায়, জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ আর কি ! এই সব ব্যস্তবাগীশ শ্রমিকদের সাথে প্রায়ই দেখা হয়ে যায় আমাদের, ঘরের দেওয়ালে, রান্নাঘরের তাকে, ঝুড়ি-চাপা মিষ্টির গায়ে, মেঝেতে, রাস্তায়, মাঠে, গাছের ডালে, ফুলের ভেতরে, কোথায় নয় ? মাঝে মাঝেই বেচারারা মারাও পড়ে আমাদের হাতে। অনেক লোক আমি এমনও দেখেছি, যাদের পিঁপড়ে দেখলেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। হয়ত কিছু একটা আদিম প্রবৃত্তি জেগে ওঠে এদের ভেতরে, সেই যখন মানুষ চাষবাস শেখেনি, সেই সময় কোনো ছোটোখাটো জীব দেখলেই হয়ত মেরে খাওয়ার জন্য মন আনচান করে উঠত, তেমন কোনো হাত-নিশপিশ করা ইচ্ছে। কিন্তু এমনও অনেক মানুষ আছে যাদের পিঁপড়েদের দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, জানতে ইচ্ছে করে এরা কেন সারাদিন এরকম ছুটে বেড়ায়, কিসের এত ব্যস্ততা এদের, কিসের জন্য এত কাজ করা ? অনেক বৈজ্ঞানিক এই ধরণের নানান প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন নানান প্রজাতির পিঁপড়েদের নিয়ে গবেষণা করে। সেই সব গবেষণার বিশদ বিবরণ না দিয়ে, আমি আজ এক ধরণের পিঁপড়ে নিয়ে গল্প করব। এদের সাধারণ ভাষায় বলা হয় leaf cutter ants বা পাতা কাটা পিঁপড়ে। মধ্য আর দক্ষিণ আমেরিকার দুই প্রজাতি মিলিয়ে ৩৯টি উপজাতি বা species-এর পিঁপড়েকে এই নাম দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে সব থেকে পরিচিত নাম হল Atta sexdens। সেই Atta-কে ধরেই তাহলে গল্পটা চলুক।
পানামার জঙ্গলে বেড়াতে গেলে একটা মজাদার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে সহজেই। সারি দিয়ে পাতার টুকরো হেঁটে চলেছে গাছের ডালের ওপর, নেমে যাচ্ছে মাটিতে, ঢুকে যাচ্ছে মাটির ঢিবির মধ্যে। একটু কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে যে প্রতিটা পাতার টুকরোকে আসলে ঘাড়ে করে বয়ে যাচ্ছে এক একজন পিঁপড়ে। Atta sexdens-এর বাসার বাইরে পাহারা দেয় যোদ্ধা বা soldier-রা। এরা সবচেয়ে বড় মাপের শ্রমিক,আর তেমনই বড় আর শক্ত এদের চোয়াল। বাসার আশেপাশে কাউকে হানা দিতে দেখলেই সেই চোয়ালের কামড়ে তাকে ঘায়েল করে দেয় যৌথভাবে। পাতা কেটে আনা আর মাটির নীচে গর্ত করার কাজ যাদের, তারা হল forager-excavator। এরা যোদ্ধাদের থেকে আকারে কিছুটা ছোট, কিন্তু এদের চোয়ালেও বেশ জোর, নাহলে মোটা, শক্ত পাতা কাটবে কি করে, আর মাটিই বা খুঁড়বে কি করে। মাটির তলায় ঢোকার আগে একবার বাসার বাইরেটা দেখে নেওয়া যাক।
জঙ্গলের মাঝখানে একটা বড়সড় ফাঁকা জায়গায় একটা মাটির ঢিবি। তার মাথার ওপর অনেকগুলো চূড়া ধরণের মুখ, অনেকটাই বাচ্চাদের তৈরী বালির দূর্গের (sand castle) চূড়ার মতো। এই অদ্ভূত গঠনের দুরকম উপযোগিতা : এক, বৃষ্টি হলে বেশী জল বাসার ভেতরে ঢুকতে পারবে না, কারণ ফুটোগুলো ছোট, আর দুই, বাসার ভেতরে বেশী গরম হয়ে গেলে মাঝের অপেক্ষাকৃত বড় মুখ দিয়ে গরম হাওয়া বেরিয়ে যাবে, আর পাশের ছোট ছোট মুখগুলো দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে আসবে – প্রাকৃতিক air conditioning system ! মাটির নীচে রয়েছে এদের বিস্তৃত বাসা। ছোট-বড় মিলিয়ে হাজার দুয়েক খোপ(chamber)- ছোটগুলো চাষের ঘর, আর বাসার বাইরের দিকের বড় খোপগুলো ময়লা ফেলার জায়গা। এই চাষের ঘরগুলোর মেঝেতে বিছিয়ে দেওয়া হয় পাতার সার। সেই সার তৈরী করার কাজ আর একদল শ্রমিকের। এরা আরো ছোট, বাসার বাইরে যায় না এরা কোনদিন। পাতা বয়ে আনার পর forager-দের কাজ শেষ। এবারে এই বাসার ভেতরে থাকা intranidal specialist-রা চাষের কাজে লেগে যায় সেই পাতা নিয়ে। পাতার টুকরো চিবিয়ে মন্ড করে তার সাথে মেশে পিঁপড়ের মল, অনেকটা যেমন আমরা গাছের গোড়ায় গোবর দিই তেমন। তারপর সেই সারের মধ্যে পুঁতে দেয় এক টুকরো fungus। না, যে কোনো fungus হলেই চলবে না, তাকে হতে হবে একটা বিশেষ প্রজাতির। অনেক বৈজ্ঞানিক মনে করেন যে সব প্রজাতির চাষী পিঁপড়েই Leucocoprinus gongylophorus-এর চাষ করে। ঠিক কোন প্রজাতির fungus তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এক বাসায় যে কখনো একাধিক রকমের fungus পাওয়া যায় না তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সবথেকে ছোট মাপের যে শ্রমিক, তারা হল নার্স-কাম-মালি। এদের কাজ রাণী আর তার কাচ্চাবাচ্চাদের খাওয়ানো, আর fungus-দের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে রোপণ করা। তাছাড়া, মালি যেমন শুধু বীজ রোপণ করেই ক্ষান্ত হয় না, তার চারা গাছের আশেপাশে গজিয়ে ওঠা আগাছাদের উপড়ে ফেলে দিয়ে চারাদের বাড়তে সাহায্য করে, এই মালি-পিঁপড়েরাও তেমন আগাছা fungus দেখলেই সেগুলো উপড়ে ফেলে দিয়ে তাদের সাধের প্রজাতিটিকে ভেজালহীন অবস্থায় লালন করে। এদের এই নিখুঁত monoculture অনেক বৈজ্ঞানিককেই হিংসায় ফেলবে, কারণ bacteria বা fungus নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কোনো না কোনো ‘আগাছা’-র অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি এমন microbiologist বিরল।
এখানেই শেষ নয়। যাতে তাদের এই যত্নে লালন করা বাগানের ক্ষতি না হয়, তাই এই পিঁপড়েরা দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করে একে অপরকে পরিষ্কার করতে, রাণীকে পরিষ্কার করে দিয়ে বাসা থেকে যতটা সম্ভব ময়লা সরিয়ে ফেলতে। গায়ের ময়লা পরিষ্কার করে তারা জমিয়ে রাখে মুখের ভেতরে একটা থলেতে। ময়লা ফেলার ঘরগুলো বাসার বাইরের দিকে, সেখানে জমা করা হয় মৃতদের, যত এঁটোকাঁটা, চাষের ঘরের আবর্জনা, আর ওই মুখের ভেতরে জমে থাকা ধুলো-মাটির দানা। ওই ময়লা ফেলার ঘরে জমে থাকা সবকিছু আস্তে আস্তে মিশে যায় মাটির সাথে। পিঁপড়েদের কাজে না লাগলেও, এর থেকে লাভ হয় আশেপাশের গাছেদের। চাষী-পিঁপড়েদের বাসার ময়লা ফেলার ঘরে হানা দেয় গাছের শেকড়, শুষে নেই পুষ্টির উপাদান। প্রকৃতির চাকা ঘুরে চলে।
কিন্তু এত আয়োজন কি শুধুই শখের বাগান সাজাতে ? অবশ্যই নয়। পিঁপড়েদের সাথে fungus-দের এই অদ্ভূত বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে আর সেই বন্ধুত্ব দিনে দিনে এমন প্রখর হয়ে উঠেছে যে একজনকে ছাড়া অন্যজনের বাঁচাই দায়। চাষী পিঁপড়েরা এভাবে সযত্নে পুষে রাখে বলেই এই fungus-রা শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বেঁচে থাকে। এক একটা Atta-র বাসার আয়ু তার রাণীর আয়ুর সমান, মানে বছর কুড়ি। এই কুড়ি বছরে এইসব বাসা মাটির নীচে ৫০-৮০ লক্ষ শ্রমিক নিয়ে এক একটা রাজত্ব হয়ে ওঠে। আর এই শ্রমিকরা, তাদের রাণী আর তার কাচ্চাবাচ্চারা, সবার খাবারের ভাণ্ডার এই fungus-এর গায়ে তৈরী হওয়া gongylidium। এই প্রজাতির fungus-দের শরীরের এই বিশেষ অংশটি এদের নিজেদের কোনো কাজেই লাগে না, এই gongylidium-নামক অংশের একটাই কাজ – পিঁপড়েদের খাদ্য হওয়া ! নার্সরা fungus-এর ছোট ছোট টুকরো কেটে দেয় বাসার বাকিদের খাওয়ার জন্য, আর সেই টুকরো নিয়ে নিজেরা খাওয়ায় রাণী আর তার বাচ্চাদের। এই fungus না পেলে Atta বা তাদের মতো অন্য পিঁপড়েরা বাঁচবে না, আর তাই প্রিয় খাবারের অভাব না ঘটতে দেওয়ার জন্য চাষ করে এরা, আদিম মানুষ বা অন্যান্য পিঁপড়েদের মতো খাবারের খোঁজে ছুটে না বেড়িয়ে। প্রথম মানুষের জন্মের বেশ কয়েক কোটি বছর আগে থেকেই এই ক্ষুদে চাষীরা সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে মাটির নীচে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কতজন তার খবর রাখে ?