মোটামুটি একটা শান্ত দিন দেখে এই পরীক্ষাটি করুন। একটা সুতোর ডগায় একটু গোল আকারের একটা পাটকেল বেঁধে ঝুলিয়ে দিন। পাটকেলটাকে অল্প তুলে ছেড়ে দিন। কাঁটা ধরে দেখুন দশ মিনিটে পাটকেলটা কতবার যে প্রান্ত থেকে ছেড়েছিলেন, সেই প্রান্তে ফিরলো। আবার একবার দোলান। এবার দোলানোর সময় আরেকটু উপর থেকে ছাড়ুন। আবার মাপুন দশ মিনিটে কতবার। দেখবেন, আগেরটার সাথে এর খুব একটা তফাত নেই। যত উপর থেকেই ছাড়ুন ( মোটামুটি লম্ব থেকে ৩০ ডিগ্রী কোণের মধ্যে), ঘড়ির কাঁটা একই গল্প বলে!
এটা আপনি বানালেন সবথেকে সোজা, গোদামার্কা একটা পেন্ডুলাম (pendulum)। আর যেটা মাপলেন, সেটা হলো পেন্ডুলামের frequency বা কম্পাঙ্ক (দশ মিনিটকে যদি আপনি সময়ের একক ধরেন) । এই কম্পাঙ্ক একান্তই পেন্ডুলামের নিজস্ব বৈশিষ্ট, আপনি তার উপর আপনার মর্জি চাপাতে পারবেন না।
সেই আশাতেই আশ্বস্ত ছিলেন খ্রীষ্টিয়ান হয়গেন্স (নামের সঠিক ডাচ উচ্চারণ শুনতে এখানে দেখুন)। মিনিটে পেন্ডুলাম যদি পনেরবার দোলে, তাহলে ওই পেন্ডুলামের পনেরটা দোলকেই এক মিনিট বলা যায়। যেহেতু ওই পেন্ডুলামের পনেরটা দোল সারতে সময়ের ব্যবধানের কোনো হেরফের হবে না, তাই এক মিনিট যখন নির্ধারণ করছি পেন্ডুলাম থেকে, প্রত্যেকবার একই সময়ের ব্যবধানের কথা বলছি। সময় এবং তার থেকে দ্রাঘিমা মাপার এই উপায়টি বার করেছিলেন হয়গেন্স।
কিন্তু এক সমুদ্রযাত্রার সময় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে পড়ে এক অদ্ভূত জিনিস লক্ষ্য করলেন তিনি। দুটো পেন্ডুলাম ঝুলছিলো কড়িকাঠ থেকে। যেভাবেই তাদের শুরু করা হোক না কেন, খানিকক্ষণ বাদে তারা একই হারে ঠিক উল্টোদিকে দুলছিল। শুধু যে দুজনের কম্পাঙ্ক এক হয়ে গেছে, তাই নয়; যে সময়ের ব্যবধানেই দুটোকে ছাড়া হোক না কেন, খানিক বাদে তারা একে অপরের ঠিক উল্টো দিকে চলছিল। এ যদি থাকে এই প্রান্তে, তো ও ওই প্রান্তে। এ যদি থাকে মধ্যিখানে আর ডান দিকে ছোটে, তো ও-ও থাকবে মধ্যিখানে আর বাঁদিকে ছুটবে। বিজ্ঞানের ভাষায় তারা তখন ১৮০ ডিগ্রী out of phase। পেন্ডুলাম দুটো আলাদা, অথচ একে অপরের উপস্থিতি টের পাচ্ছে যেন। একে অপরের উপর চাপাচ্ছে নিজের মর্জি! আজব ভুতুড়ে কান্ড!
সেই থেকে শুরু হলো সমলয়ন বা synchronization নিয়ে গবেষণা। পেন্ডুলামের মজা হলো, এই সহজবোধ্য বস্তুটিকে ঘিরে যে অঙ্কের পরিকাঠামো তৈরী করা যায়, সেই অঙ্ক খাটে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কিছুর উপরই। তাদের কম্পাঙ্ক বা frequency নির্ধারণ করে তাদের অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্টগুলি। এক যদি না লাগাতার তার উপর বলপ্রয়োগ করা হয়, তার কম্পাঙ্ক বদলানো যায় না।
দেখা গেল যে এই অদ্ভুতুড়ে সমলয়ন হয় সেই সব ক্ষেত্রেও। যেমন, বিশ শতকে লর্ড রেইলি দেখলেন, দুটো অর্গান পাইপ পাশাপাশি একসাথে বাজালে খানিক বাদে শুরু হয় এক আশ্চর্য খেল। হয় দুটোর গহ্বর থেকে একটাই আওয়াজ শোনা যায়, কিম্বা একে অপরের আওয়াজকে দাবিয়ে দেয় একেবারেই।
তারপর, ১৯২০ সালে আপেলটন ও ভ্যান ডার পল দুই বিজ্ঞানী triode generator-এর মধ্যেও দেখলেন একই কান্ড। দুটো জেনারেটার, আলাদা কম্পাঙ্কের A/C কারেন্ট উতপাদন করে। অথচ একে অপরের উপস্থিতি টের পেলেই কারেন্টের কম্পাঙ্ক এক হয়ে যায়।
এ তো গেল মনুষ্যসৃষ্ট বস্তুর কথা। প্রকৃতির মধ্যেও এর পরিচয় মেলে। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলে বাস করা জোনাকির ঝাঁকে। পর্যটকরা দেখেছেন, সন্ধ্যে হলে জোনাকিরা যখন ঝাঁকে ঝাঁকে এসে গাছের উপর চড়াও হয়, গাছ জুড়ে শুরু হয় ঝিকিমিকি। প্রথমে খাপছাড়া ভাবে। সবাই নিজের খেয়ালে জ্বলছে আর নিভছে। কিন্তু রাত যত গড়াতে থাকে, শুরু হয় এক অদ্ভূত আলোর খেলা। জোনাকির ঝাঁক একসাথে জ্বলে আর নেভে, যেন কেউ তাদের তালিম দিয়েছে। এখানে কিন্তু আর একটা “পেন্ডুলাম” নয়, কাতারে কাতারে “পেন্ডুলাম” একই কম্পাঙ্কে আটকা পড়ে গেছে।
এ কি করে সম্ভব? সুদুরবিস্তৃত জোনাকির ঝাঁক এক তালে নাচছে যেন — তালিম পাচ্ছে কোথায় এরা? এই প্রশ্ন ব্যতিব্যস্ত করে তুললো বিজ্ঞানীদের।
উত্তর কিছুটা হয়ত আঁচ করা গেছে। সেই গল্প পরের পর্বে। শেষ করার আগে সমলয়ন কিরকম অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা দেয়, তার এক অদ্ভূত নমুনা দিই। ২০০০ সালের ১০ই জুন। লন্ডনে উদ্বোধন হলো মিলেনিয়াম ব্রিজের। টেমস নদীর উপর ঝুলন্ত সেতু। অভিনব তার গঠন। উদ্বোধনের দুদিনের মধ্যে বন্ধ করে দিতে হলো। কেন? লোকজন চাপতেই ব্রিজ দুলতে শুরু করলো। একটু আধটু নয় যে দুলছি কি দুলছি না বুঝতে বুঝতেই ব্রিজ পেরিয়ে গেলাম। এতটাই যে মাঝপথে লোকজনকে থেমে রেলিং ধরে হাঁটতে হচ্ছিল। জায়গায় জায়গায় ৭৫ মি.মি. অব্দি সরে যাচ্ছিল জমি।
এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। সবরকম পরীক্ষা করেই তারপর সেতু পাবলিকের জন্য খোলা হয়েছিল। তাহলে এত বড় গলদ থেকে গেল কি করে? তদন্তে নামলেন ইঞ্জিনিয়াররা। দেখা গেল, সেতু দুলছিল ঠিক-ই, তবে সেই দোলাকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল পদচারীরা। তারা নিজেদের সামাল দিতে যখন এঁকেবেঁকে চলছিলো, সবাই পা ফেলছিল এক তালে। এক তালে!! কি করে সম্ভব হলো এটা? আবার তালিম ছাড়াই সমষ্টির মধ্যে দেখা গেল আশ্চর্য সংগতি।
পরে কখনো এই কাহিনীর অন্য একটা চেহারা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। বিজ্ঞানীরা কিভাবে কয়েকটা সহজ সূত্র থেকে শুরু করে ওই সমষ্টিগত সংগতিকে কম্পিউটারে তৈরী করেছেন। আর কিভাবে তাকে কাজে লাগিয়েছেন গবেষনাগারে।
ছবি: স্মিথসনিয়ান ম্যাগাজিন