প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের পর …
পর্ব ৪ – ব্যাকটেরিয়া কোষের বাহ্যিক গঠন
আগের পর্বে আমরা ব্যাকটেরিয়া কোষের বাহ্যিক গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। আমাদের কোষের বাইরে কেবলমাত্র একটি কোষ-পর্দার আবরণ থাকলেও ব্যাকটেরিয়া কোষের বাইরে অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা, কোষ-প্রাচীর ও বাহ্যিক কোষ-পর্দা এই তিনটি স্তরের প্রতিরক্ষা বলয় কেন থাকে সে বিষয়েও আমরা স্বল্প-বিস্তর জেনেছি।
এই পর্বে আমরা ব্যাকটেরিয়া কোষের বিভিন্ন বাহ্যিক আবরণের (অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা, কোষ-প্রাচীর ও বাহ্যিক কোষ-পর্দা) গঠনগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরো ভালো করে জানব। ব্যাকটেরিয়া কোষের কোষরস বা cytoplasm বেষ্টন করে যে আবরণ থাকে তাকে অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা বা inner membrane বলে। অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা দুটি ফসফো-লিপিড এর স্তর দিয়ে তৈরী এবং সাধারণত ৫-৮ ন্যানো মিটার (৫-৮ x১০-৯ মিটার) পুরু একটি আস্তরণ। বলে রাখা ভালো যে কোষ-পর্দার প্রধান উপাদান ফসফো-লিপিড হলেও আরো দুই রকম এর লিপিড সেখানে পাওয়া যায়: গ্লায়কোলিপিড ও কোলেস্টেরল (যদিও কোলেস্টেরল ইউক্যারিওট কোষেই বেশী দেখা যায়)।
একটা প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে কোষ-পর্দায় লিপিড এর দুটি স্তর থাকে কেন? উত্তরটা লিপিড অণুর গঠন দেখলে সহজেই বোঝা যাবে।
লিপিড অণুর গঠন, প্রোটিন বা শর্করা অণুর থেকে বেশ আলাদা। লিপিড অণুর এক প্রান্তে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন এর প্রাধান্য থাকে এবং এই প্রান্তে চার্জ থাকার জন্যে জলীয় তরলে সহজেই মিশে থাকতে পারে (polar end); অন্য প্রান্ত প্রধানত কার্বন ও হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরী এবং কোনো চার্জ না থাকায় জলীয় তরলের থেকে সব সময় দূরে থাকতে চায় (nonpolar/hydrophobic end)।
কোষের ভিতর কোষরস এবং বাইরে পেরিপ্লাসম যেহেতু জলীয় তরল দিয়ে তৈরী তাই কোষ পর্দা গঠনের সময় লিপিড অণু গুলি নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে পাশাপাশি দুটি স্তরে এমন ভাবে সজ্জিত হয় যে nonpolar প্রান্ত গুলি সবসময় একে-অপরের সংস্পর্শে থাকে আর polar প্রান্ত গুলি কোষরস বা পেরিপ্লাসমের সংস্পর্শে থাকে। কোষ-পর্দা দুটি লিপিড এর স্তর দিয়ে তৈরী না হলে তা কখনই স্থিতিশীল হত না।
কোষ-পর্দার প্রধান উপাদান লিপিড হলেও, সেখানে প্রচুর পরিমানে এবং বিভিন্ন রকমের প্রোটিন উপস্থিত থাকে। প্রকৃতপক্ষে, উপাদানগত দিক দিয়ে দেখতে গেলে কোষ-পর্দাতে প্রোটিন ও ফসফো-লিপিড এর পরিমান প্রায় সমান। কোষ-পর্দার সঙ্গে যুক্ত প্রোটিনগুলিকে প্রধানত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়:
১) অবিচ্ছেদ্য মেমব্রেন প্রোটিন (Integral membrane proteins/ transmembrane proteins), এবং
২) প্রান্তিক মেমব্রেন প্রোটিন (Peripheral membrane proteins)।
নাম থেকেই বুঝতে পারছো, অবিচ্ছেদ্য মেমব্রেন প্রোটিন কোষ-পর্দার মধ্যেই সবসময় নিবদ্ধ থাকে কিন্তু প্রান্তিক মেমব্রেন প্রোটিন সময় বিশেষে কোষ-পর্দার সাথে সংযুক্ত হয়। কোষরসের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের আয়নের সাম্য রক্ষা, পাশাপাশি দুটি কোষের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন, কোষ-পর্দার মধ্যে দিয়ে বিশেষ বিশেষ প্রোটিন বা অন্যান্য অণু-পরমাণুর প্রবেশ ও নিকাশী ব্যবস্থায় মেমব্রেন প্রোটিন এর ভূমিকা অপরিসীম। একথা বলাই বাহুল্য, ফসফো-লিপিড আর প্রোটিন এর সমন্বয়ে তৈরী কোষ পর্দার কোনো ইট-পাথরের তৈরী দেয়াল এর মত নিশ্চল সীমারেখা না বরং দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি গঠন। কোষ পর্দার Fluid mosaic model সম্পর্কে তোমরা নিশ্চই স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে পড়েছ তাই সে বিষয়ে এখানে আর আলোচনা করছি না।
ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দার আর আমাদের কোষের কোষ-পর্দার মধ্যে দৃশ্যত খুব একটা তফাৎ না থাকলেও গঠনগত ও উপাদানগত বিস্তর পার্থক্য আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমাদের কোষ-পর্দার গঠনগত উপাদান গুলির মধ্যে অন্যতম হলো কোলেস্টেরল (মোট লিপিড এর প্রায় ২০%) কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার কোষ পর্দাতে কোলেস্টেরল একেবারেই থাকে না! আবার ব্যাকটেরিয়ার বাহ্যিক কোষ-পর্দায় lipidA-এর বহুল উপস্থিতি দেখা গেলেও আমাদের কোষ পর্দাতে কদাচিৎ lipidA দেখা যায়।
বাহ্যিক কোষ-পর্দা বলতে মনে পড়ল, তোমাদের তো এখনো বলাই হয়নি যে অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা ও বাহ্যিক কোষ-পর্দা উভয়ই দুটি লিপিড স্তর দিয়ে তৈরী হলেও দুটির গঠনগত উপাদান ও বৈশিষ্ট্য কিন্তু অনেকটা স্বতন্ত্র ! তোমরা আগের দিনের (পর্ব-৩) ছবিতে নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ বাহ্যিক কোষ-পর্দার বাইরের দিকের লিপিড স্তরে অনেকটা সরু সরু রোঁয়ার মত গঠন থাকে যাদের লাইপোপলিস্যাকারাইড (lipopolysaccharide: LPS) বলে। প্রতিটি লাইপোপলিস্যাকারাইড অণু একটি লিপিড ও অনেকগুলো শর্করা অণুর সমন্বয়ে তৈরী। অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দায় কিন্তু এই LPS থাকে না। LPS ব্যাকটেরিয়া কোষের বাহ্যিক গঠন কে মজবুত করে ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থেকে ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করে। জেনে রাখা ভালো, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে আমাদের অনেক সময় যে জ্বর বা উদরাময় হয় তার অন্যতম প্রধান কারণ এই LPS। তাই LPS এর উপস্থিতি টের পেলেই আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (immune system) সজাগ হয়ে ওঠে।
এতো গেল অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা ও বাহ্যিক কোষ-পর্দার গল্প, মাঝের কোষ প্রাচীর এর ভূমিকা তাহলে কি ? কোষ প্রাচীরের কাজ কি শুধুই কাঠিন্য প্রদান করা ? ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমরা যে অ্যান্টিবায়োটিক (antibiotic) এর ব্যবহার করি তা কোষ প্রাচীর এর গঠন কে কেমন ভাবে নষ্ট করে সেই সব জানতে পরের পর্বে নজর রাখো।
লিপিড ছবি সৌজন্যে: https://en.wikipedia.org/wiki/