আমাদের লোকসমাজে একটা বেশ চালু কথা আছে, কাউকে যদি এড়িয়ে চলতে চাও তবে তাকে কিছু টাকা ধার দাও। বহু লোককে দেখেওছি টাকার জন্যে কি ভীষণ ভাবে তাগাদা দিতে। আমার কাছে Popular Science-এর article লেখার জন্যে তাগাদা এই প্রথম ! প্রতিদিন দুপুরে খাবার পর যে একটু নিশ্চিন্তে ঝিমিয়ে নেব তার জো নেই। কুণালদা আসবে আর এসেই খালি লেখার কথা বলবে। গত তিনমাস ধরে ধারাবাহিক ভাবে প্রতিদিন এ আপাত অত্যাচার চলছেই। প্রায় একমাস আগে একদিন দুপরে field-এ গিয়ে মৌমাছিদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করবো বলে তৈরি হচ্ছি আর তক্ষুণিই কুণালদা চা-এর কাপ হাতে হাজির। আমি বুঝে গেলাম হঠাৎ এই আবির্ভাবের কারণ। আমি আমার কাজের ব্যস্ততার কথা জানাতেই কুণালদা একটু ব্যাঙ্গের সুরেই বললো, “গোটা শীতকাল কাজ করিস নি আর এখন এই গরমের দিনে মৌমাছি দেখতে যাচ্ছিস, ভাঁওতা দেবার আর জায়গা পাও নি ?” ব্যাস্ আমি বুঝে গেলাম কুণালদা গরম আর শীতকালে মৌমাছিদের আচরণের তারতম্যটা আদৌ জানে না আর এও জানেনা যে শীতকালে মৌমাছিরা সেরকম মৌচাক থেকে বেরোয় না, জায়গা পেয়ে গেলাম কুণালদাকে goal দেওয়ার। কিন্তু উদ্যমী কুণালদা সব শুনে হাসতে হাসতেই বললো, “এইতো এতদিন subject পাচ্ছিলি না, নে এবার এটা নিয়েই ‘বিজ্ঞান’-এর জন্যে একটা লেখা লিখে ফ্যাল।” এটা কিন্তু মন্দ নয়, আমারও বেশ মনোমত হল আর তাই তোমাদের জন্যে লিখতে বসে গেলাম মৌমাছিদের ব্যাপারে আমার নিজের চোখে দেখা গরম আর শীতকালের দুটো অদ্ভুত behaviour নিয়ে।
সবার প্রথমে তোমাদের মৌমাছির বাসা মানে মৌচাক আর মৌমাছিদের সমাজের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে দিই। মৌমাছিরা বেশ সামাজিক জীব আর মৌচাক কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ওদের মৌ-সভ্যতা। মৌচাক যেন অনেকটা দুর্গের মতো। কর্মী-প্রহরী বেষ্টিত দুর্গের ভিতরে রয়েছে মূলত তিন ধরণের কক্ষ – আঁতুরঘর, ভাঁড়ারঘর আর বৈঠকখানা। আঁতুরঘরে চলে ডিম, সদ্যজাত লার্ভা এবং শুককীটের রক্ষণাবেক্ষণ, ভাঁড়ারঘরে হয় মধু ও পরাগরেণুর সঞ্চয় আর বৈঠকখানায় মৌমাছিদের মধ্যে চলে আলাপ-আলোচনা। নানারকম নাচ করে নিজেদের মধ্যে খবর বিনিময় করে ঠিক কোথায়, কতদূরে মধুর সন্ধান আছে, সে এক অন্য বিষয়। এ সবই খাটনীর কাজ করে কর্মী মৌমাছিরা।
কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি ছাড়াও মৌচাকে আরও দু ধরণের মৌমাছি থাকে। রানী, যাদের কাজ হলো শুধুই ডিম পাড়া আর পুরুষ মৌমাছির কাজ হলো রানী মৌমাছির গর্ভসঞ্চার করা । এক একটা মৌচাকে প্রায় ৫০,০০০ কর্মী-মৌমাছি থাকে। এই কর্মী মৌমাছিরা যাবতীয় পরিশ্রম করে থাকে। অন্যান্য অনেক কাজের সাথে মূল যে দুটো কাজ এরা করে তা হলো মধু-পরাগরেণু খুঁজে সংগ্রহ করে এনে সঞ্চয় করা আর লার্ভাদের খাইয়ে-দাইয়ে বড় করা। কর্মীরা এই লার্ভাদের খুব যত্ন-আত্তি করে যাতে সেগুলোর কোনো ক্ষতি না হয় ।
লার্ভারা বড্ড সুখি প্রকৃতির, মৌচাকের তাপমাত্রার একটু হের-ফের হলেই ফল হয় মারাত্মক। তাই মৌচাকের অন্তঃপুরের উষ্ণতা 30°C থেকে 32°C -এর মধ্যে বজায় রাখাটা খুবই জরুরী। পরিণত মৌমাছিরা যদিও 10°C থেকে 50°C তাপমাত্রা অবধি বেশ সামলে নেয় কিন্তু অপরিণত মৌমাছি অর্থাৎ লার্ভা বা শুককীটের সহ্য ক্ষমতা বেশ কম। আঁতুরঘরের তাপমাত্রা 34.5°±1.5° -এর বাইরে গেলেই এদের মধ্যে মড়ক দেখা যায়। খুব গরমে ডিম নষ্ট হয়ে যায় অথবা স্বাভাবিক জৈবিক বৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটে হয়ে যায় বিকলাঙ্গ। অন্যদিকে ঠাণ্ডা বেড়ে গেলেও হয় অনেকরকম সমস্যা। যেমন রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতার হ্রাস পায় তেমনি খাদ্য সংগ্রহ এবং সঞ্চয়ে তারা হয়ে পড়ে বেশ অপটু। তাই অন্তঃপুরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখতে এদের মধ্যে বেশ কিছু দারুণ আচরণের পরিবর্তন দেখা যায়।
প্রথমে গরমকালের কথাই তোমাদের বলি। গরমে যখন চারপাশের তাপমাত্রা খুব বেড়ে যায় তখন একদল কর্মী-মৌমাছি উঠে-পড়ে লাগে যাতে বাসার তাপমাত্রা বেড়ে না যায়। কি করে হয় আন্দাজ করতে পারো কি ? কিছু কর্মী-মৌমাছি বাইরে থেকে জল এনে বাসার ভিতরে ছিটিয়ে দেয় আর একদল সাথে সাথে ডানা নেড়ে হাওয়া করতে থাকে। এই ঠান্ডা করার সহজ ব্যাপারটা এবার বুঝে গেছ কিন্তু এর সাথে আরও ঘটনা ঘটে যাকে বলে heat shielding, কমবয়সী শ্রমিক-মৌমাছিরা নিজেদের দেহের আঁতুরঘর থেকে তাপ শুষে নিয়ে বাইরে উড়ে গিয়ে সেই তাপ ছেড়ে দেয়। এই গরমে জল আরও একটা ব্যাপারে বেশ জরুরী। খুব তাপে জল শুকিয়ে মধুর মধ্যের শর্করাগুলো crystallised হয়ে খাবার অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে তাই মধু তরল রাখতেও জলের যোগান দরকার।
এবার আসি শীতকালের ঘটনায়। শীতকালে ঠিক কি হয় ? শীতকালে নজর রাখতে হয় তাপমাত্রা যেন খুব কমে না যায়। কুঠুরীগুলো গরম রাখার পদ্ধতিটা সত্যিই বেশ মজার। শীতকালে যেমন আমরা ভাই-বোনেরা সবাই মিলে খুব কাছাকাছি ঘেঁষে দাদু-দিদিমাকে ঘিরে গল্প শুনতে বসি এরাও কতকটা একই ভাবে অনেকে মিলে আঁতুরঘরের চারপাশে ভিড় জমায়। কর্মী-মৌমাছিরা একে অপরকে ঘিরে গায়ে গা লাগিয়ে একটা cluster তৈরি করে। Cluster-এর বাইরের মৌমাছিরা তাদের ঘিরে একটা তাপপ্রতিরোধক(thermal insulating ) বলয় সৃষ্টি করে, ফলে ভিতরের তাপ বাইরে যায় না আর অন্তঃপুর বেশ গরম থাকে। এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার বলা বেশ প্রয়োজন। এই আঁতুরঘরের সংলগ্ন মৌমাছিরা ডানা একদম না নেড়ে তাদের ওড়ার জন্য বক্ষদেশে যে পেশীগুলো (thoracic flight muscle ) আছে তাদের isometric contraction ঘটায়। Isometric contraction -এর মাধ্যমে যে বিপাকীয় তাপ নির্গত হয় সেটাকেই কাজে লাগায় কুঠুরী গরম করতে।
এই isometric contraction-এর ফলে কিভাবে তাপ নির্গত হয় সেটা তোমাদের একটু বুঝিয়ে বলি। পেশীর সংকোচন-প্রসারণের ফলে যে আমরা কাজ করতে পারি এটা তোমরা সবাই জানো। এক্ষেত্রে পেশী কোষের দৈর্ঘ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে আর পেশী কোষেকে এই কাজের শক্তি যোগায় ATP অণু। Isometric contraction-এ কিন্তু পেশী কোষের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন মোটেই ঘটেনা। ধরো তুমি একটা ইঁট হাতে তুলে একই জায়গায় ধরে রেখেছো সেক্ষেত্রে পেশী কোষের দৈর্ঘ্য কিন্তু অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। ইঁট-টাকে একই জায়গায় ধরে রাখতে কিছু বিপাকীয় কার্যকলাপ চালু রয়েছে যার ফলে উত্পন্ন হয় কিঞ্চিত তাপশক্তি। এবার মনে হয় কিছুটা পরিস্কার হলো। তবে অন্তরবলয়ের মৌমাছিরা অতরিক্ত পরিশ্রম করে যাতে ক্লান্ত না হয়ে পড়ে তাই বাইরের বলয়ের মৌমাছিদের সাথে মাঝে মাঝে স্থান পরিবর্তন করে নিজেদের কাজটা ভাগাভাগি করে নেয় আর এভাবেই শীতকালেও মৌচাকের ভিতরের উপযুক্ত তাপমাত্রা ঠিক বজায় থাকে। এতক্ষণ ধরে তোমাদের যেটা বললাম সেটা আসলে মৌমাছিদের মৌচাকের ভিতরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের একটা দারুণ কৌশল। প্রকৃতিতে জীব-জগতের কিছু ঘটনা সত্যিই চমকপ্রদ !
ছবি : অরুময় চ্যাটার্জ্জী
বিভিন্ন সূত্র :
১ https://link.springer.com/article/10.1007%2Fs00114-014-1174-2
২ Asian Honey Bees: Biology, Conservation, and Human InteractionsBy Benjamin P. Oldroyd, Siriwat Wongsiri
৩ The Wisdom of the Hive: The Social Physiology of Honey Bee Colonies, Thomas D. Seeley
°