ন্যাড়াদা-র মাথাখানি একেবারে ভেলভেট।
বেলতলা গিয়ে শেষে হল তার মাথা হেঁট।
বাড়ি ফিরে দোর এঁটে
ভাবলো সে খুব বটে,
এরপরে নিয়ে যাবে এক খানা হেলমেট্ !
(লিমেরিক : কুণাল চক্রবর্ত্তী)
দিল্লীর সুলতান মোহম্মদ বিন্ তুঘলকের নাম কে না জানে । তাঁর তুঘলকি কাজকম্মো ইতিহাসের ছাত্রের কাছে আইপিএল এর চার-ছয়ের থেকে কোন অংশে কম নয়। ভাবুন তো, তিনি খোরাসান অভিযান করবেন বলে এক বছর ধরে এক বিশাল বাহিনী পুষেছিলেন । শুধুমাত্র পোষেন নি, রীতিমত প্রত্যেক সৈন্যের সামরিক-শিক্ষাদীক্ষা থেকে শুরু করে তাদের পেনশন্ প্ল্যান পর্যন্ত সুলতানের নজরে ছিল। কেন তিনি খোরাসান বিজয়ের কথা ভেবেছিলেন, আবার কেনই বা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি স্বত্বেও শেষমেশ অভিযান আর করেন নি, তা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেও, আজ আমরা কিছুটা হলেও জানি তিনি কেন অতবড় হিসেব করেও, সময়কালে কাজটা করে উঠতে পারেন নি। অবশ্য, এই ধরণের উদাহরণ আজকের দিনে যে কোন ধূমপায়ীকে শুধোলেও আপনারা পেয়ে যাবেন। কেন যে, কোন অমোঘ কারণে গত সিগারেটের লাল-পানা মুখের সামনে করা ধনুকভাঙ্গা পণ,নতুন সিগারেটের প্যাকেটের রাঙতায় বারবার ভেঙে যায় সে কথা ভাবতে বসলেই আজকের এই লেখাটি পড়ে ফেলা যাবে।
উনিশ শতকের শেষ লগ্নে এসে, রুশ বিজ্ঞানী আইভান পেত্রোভিচ পাভলভ পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণ করেন, Classical Conditioning মারফত প্রাণীরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। কি এই Classical conditioning? ফিরে যান আমাদের ছেলেবেলায় গ্রামের স্কুলের জাঁদরেল হেড-মাস্টারের উদাহরণে। স্কুলের করিডরে তাঁর জুতোর শব্দ শোনা মাত্রই পিঠের মাংসপেশি কনকন করে উঠত। কেন উঠত সেটা ওই Classical conditioning। যেদিন প্রথম পড়া না পারার দিনে পিঠের ওপর হেডস্যারের বেত সপাং সপাং করে আছরে পড়েছিল, সেদিন তাঁর জুতোর শব্দ চোরের মত কিভাবে কানে ঢুকে গেছিল টের পেয়েছিলেন? কিংবা, তাঁর সেই ১২০ জর্দার তামাকের কড়া গন্ধ? বিজ্ঞানের পরিভাষায়, সেদিন Unconditional Stimulus ছিল ওই তেল-চিকচিকে বেতের কঠিন স্পর্শসুখজনিত বেদনা আর Unconditional Response ছিল আপনার পিঠটান। তখনও বোঝেন নি, বেত পিঠে পড়া মাত্রই পা’দুটো কেন উসেইন বোল্টের বেগে আপনাকে ছুটিয়েছিল। পরবর্তী কালে ক্লাস-বিরতিতে টেবিল বাজিয়ে গান করার সময় হঠাত হেডস্যারের সন্দর্শনে কিম্বা জুতোর শব্দে, মায় জর্দার গন্ধে পর্যন্ত আপনার পলায়ন-প্রবৃত্তি সেই ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত “Lectures on the functions of the principal digestive glands” শীর্ষক ন্যারেটিভে পাভলভ মশয় ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে বেত্রাঘাতের Touch sensation-রূপী Unconditional stimulus, হেডমাস্টার মশাইয়ের জুতোর শব্দ অথবা তাঁর পছন্দের জর্দার গন্ধের ন্যায় Conditional Stimulus -গুলির সাথে একই সময়ে সংঘটিত হওয়ায় শব্দ এবং গন্ধ বাবাজী ওই পলায়ন-রূপ Unconditional Response কে Conditional Response -এ পরিণত করিয়েছে। অতএব, পরবর্তী ক্ষেত্রে ওই Stimulus গুলো পাওয়া মাত্র ও’ পাড়ার ফটিকচন্দ্র জামাইকার উসেইন বোল্টে পরিণত হয়।
বিজ্ঞানের পরিভাষায় এ’ কে বলা হয় “Associative Learning”। অর্থাৎ, আপনি কোন তুলনা-মূলক ভাবে দুনিয়া সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করলেন। অনেকটা, “রাম স্তন্যপায়ী; শ্যাম স্তন্যপায়ী; সুতরাং উভয়েই স্তন্যপায়ী”-রূপের তর্কবিদ্যার তুলনার মত। পাভলভের ব্যাখ্যায় একটা উহ্য শর্ত ছিল, উল্লেখিত ক্ষেত্রে মার খাওয়ার আগে ফটিকচন্দ্রের হেডমাস্টার মশাই সম্পর্কিত কোন ভীতি থাকলে চলবেনা। আদর্শ উদাহরণে, মার খাওয়ার উৎস হিসেবে ক্লাসে ফটিকের, টিয়াদের বাড়ির সবেদা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মত-বিতরণের অবতারণা করা যেতে পারে। পরবর্তী ক্ষেত্রে বহু প্রথিতযশা ব্যাক্তিরা Sensory per-conditioning, Latent Inhibition প্রভৃতি সমান্তরাল বিষয়ে প্রচুর কাজ করেছেন যেগুলো আজকের গল্পের বাইরে। কিন্তু মুশকিলটা বাধল Motive নিয়ে।
Associative learning এর প্রণালী হিসেবে Classical Conditioning এর প্রথম সমালোচনা করেন এক মার্কিনী মনোবিদ এডওয়ার্ড এল থর্নডাইক। তিনি বলেন, কোন কিছু শিখতে হলে আগে দরকার তার পরিণাম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা এবং কোন কিছুর পরিণাম সুখদায়ক হলে সেটি লোকে বেশী করে করবে আর যদি সেটি অস্বস্তির উদ্রেক করে তাহলে লোকে তা করতে চাইবে না। আমাদের বহু আলোচিত উদাহরণটিতে ফটিকের ব্যবহার সম্পর্কে থর্নডাইকের মতানুসারে বলা যেতে পারে ফটিক ওই দিনের পরে এমন কিছু করবেনা, যাতে স্যারের বেত্রাঘাত আরেক বার সহ্য করতে হয়। একে বলে “ Law of effect” । প্রচলিত বাক্য অনুসরণে “নেড়া বেল তলায় যায় ক’বার ?” সন্ ১৯১১ তে প্রকাশিত এই তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মূল স্তরটি হল “Action” এবং তার “ Outcome”-এর Association, “Stimulus” ও “Response” এর Association নয়।
তা এই রুশ-মার্কিনী আদর্শমূলক দ্বন্দ্ব মনোবিজ্ঞানের Cold war বলা যেতে পারে। যেহেতু তখনো মাথার ভেতরে তার গুঁজে মস্তিষ্কের অলিতে গলিতে কি সঙ্কেত-মূলক বার্তা আদান-প্রদান হয় সেগুলো নিরীক্ষণ করা বিজ্ঞানীদের সাধ্যাতীত ছিল, কেউই ঠিক মত বুঝে উঠতে পারেন নি কোন পক্ষ যুধিষ্ঠির, কেই বা দুর্যোধন।
শেষমেশ ১৯৪৯ সনে ডোনাল্ড হেব নামক এক কানাডিয়ান গনিতজ্ঞ প্রথম Associative learning এর সাঙ্খ্যরূপ প্রকাশ করেন এবং প্রায় একই সময়ে হজকিন ও হাক্সলে স্কুইডের স্নায়ুকোষে বৈদ্যুতিন তার ঢুকিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
এহেন দুটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের সাহায্যে পরবর্তী ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মনোবিজ্ঞানীরা নানা সময়ে “Stimulus-Response” এবং “ Action-Outcome” এর তত্ত্ব দুটি পরীক্ষা করে দেখেছেন । এ সংক্রান্ত ব্যাপারে রেসকরলা-ওয়েগনার, যোসেফ লেদু, অ্যান্থনি ডিকিনসন, বার্নার্ড বেলিনের নাম করা যেতে পারে। বর্তমানে Behavioral Economics এর প্রভূত উন্নতি ঘটায় আমরা এই ধরণের অভিজ্ঞতা-সঞ্চয় প্রণালী সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য জানতে পেরেছি। ব্রিটিশ অধ্যাপক এডমান্ড টি রোলস তাঁর বই “ Memory, Attention and Decision making”-তে এ বিষয়ে আরো বিষদ বিবরণী দিয়েছেন। আসুন দেখি, আমরা কতটুকু জানতে পেরেছি যে ফটিকচন্দ্র ঠিক কি শিখেছে হেডস্যারের থেকে।
ফটিকের দুষ্টুমি এক্ষেত্রে Action, স্যারের বেত্রাঘাত এক্ষেত্রে Unconditional stimulus, স্যারের জুতোর শব্দ বা জর্দার গন্ধ এক্ষেত্রে আগের মতই Conditional Stimulus, প্রহারের বেদনা এক্ষেত্রে Outcome এবং ফটিকের পলায়ন ( বা তার পেশীর সঙ্কোচন, বিবিধ হরমোনের ক্ষরণ) Unconditional Response । বিজ্ঞানীদের মতে ফটিক এযাত্রা দুটি পথে শিক্ষালাভ করছে। একটি পথ “ SR Habit” এবং আরেকটি “ Goal Directed Learning” । এর মধ্যে দ্বিতীয়টি বেশ মজার। ওটিই আগে বলি।
ধরে নিন, ক্লাসের ফিচকে ছেলে সন্টা, স্যারের ক্লাসের আগে ফটিকের সাথে বাজি লড়েছিল, স্যারের কাছে বেত খেলে সে ফটিককে নলেনগুড়ের রসগোল্লা খাওয়াবে। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ফটিকের উদ্দেশ্য বা goal ছিল স্যারের মার খাওয়া। এই বিশেষ প্রবৃত্তিকে বলা যেতে পারে motivation । অনেকটা কলেজে ফেস্টে গান গেয়ে ছেলেদের হিরো হওয়ার মত। যেহেতু ছেলেটির কাছে হিরো হওয়াটি Rewarding, সে প্রাণ মনে রেওয়াজ করে বা নজড়কাড়া পোশাক পড়ে স্টেজে উঠবে। ফিরে যাই আবার ফটিকের গল্পে। যদিও উল্লেখ্য ক্ষেত্রে তার motivation ছিল নলেনগুড়ের রসগোল্লা, সন্টা যদি তাকে সে রসে বঞ্চিত করে, সে ভবিষ্যতে একই কাজ করতে দু’বার ভাববে। কাজেই, স্যারের বেত্রাঘাত এক্ষেত্রে তার ultimate goal নয়, বরঞ্চ সেই goal এ যাবার রাস্তা। এই ধরণের learning এর সুবিধা হল এর নমনীয়তা। অর্থাৎ, outcome সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে action পাল্টানোর স্বাধীনতা।
নেড়া নিশ্চয়ই বেল তলায় বার বার যাবে না। কিন্তু যদি আমাদের ফটিক নেড়া হওয়া স্বত্বেও বারবার বেল তলায় যায়? অর্থাৎ, এক বার দুষ্টুমি করেও বারবার একই ভুল পুনরায় করে, সেক্ষেত্রে তার Habitual learning প্রাধান্য পাবে। ক্লাসে ফটিকের দুষ্টুমি এবং স্যারেদের আক্রোশ তখন প্রতিদিনকার ঘটনা। কারণ, ফটিক জেনেই গেছে ওই জুতোর শব্দ কিম্বা ওই বাহারী ছাতা অথবা ওই টিকলো নাক দেখলেই সে ছুটে পালাবে। ধরা পড়লে তার কি পরিণাম সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে অকাজে বিরত থাকা তার অভিধানে নেই।
পাঠক বুঝতেই পারছেন, এই দুই ধরণের পদ্ধতি ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত এবং কোনটা মানুষ প্রথম শেখে, সে বিষয়ে এখনো সঠিক জানা যায় নি। বিশেষ করে মানুষের অগ্র মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটায় মানুষ Goal সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল এবং অন্যান্য পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত মনুষ্যেতর প্রাণীর তুলনায় জটিল ও কঠিন স্নায়ু-জালের মাধ্যমে এই ধরণের Associative learning সুচারু ভাবে সম্পন্ন করে।
কিন্তু, মানুষ যদি এতই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাহলে আমাদের গোড়ার প্রশ্নগুলোর উত্তর কোথায়? আমরা সব কিছু জেনে বুঝেও ধূমপানে বিরত থাকি না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের জানতে হবে “ Temporal Discounting” এর কথা। অর্থাৎ, ধরুন আজ সন্ধ্যে ৬টায় ভাবলাম, এই আমার শেষ সিগারেট। আর আমি খাচ্ছিনা। কারণ? “তামাক ক্যান্সারের কারণ”, “ফুসফুসটা ফুঁকে দিলে নেক্সট সিজনে চন্দ্রশীলা ট্রেকটা হবে না”, “ সিগারেট খেয়ে খেয়ে এই বয়সেই নিতাইদার বাইপাস হয়ে গেল” ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন পর্যন্ত আমাদের goal নামক decision setএ “হ্যাঁ” এর পরিমাণ ১০% আর “না” হচ্ছে “৯০%”। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা খেয়ে ওই “হ্যাঁ” করে ফেলল সেঞ্চুরী আর না পেল গোল্লা। এ কি ভোজবাজির খেলা না কি মশাই ? আসলে, এক জন ধূমপানে আসক্ত ব্যক্তির কাছে মস্তিষ্কের গোড়ায় ধুয়ো দেবার রস ষোল আনা। কিন্তু, প্রথমে temporal discountingএর খপ্পরে আর খাওয়ার ঠিক পরে opportunity cost ( ইশ সিগারেটটা খেয়ে কি ক্ষতিটাই না হল ! এই সময়ে অন্য কিছু গঠনমূলক কাজ করলে কি ভালোটাই না হত! ) এর ঠেলায় ষোল আনা ডিস্কাউন্টেড হয়ে ১০% এ নেমেছিল। ফটিকের ব্যাপারে বলতে হয় সে স্যারের বেতে অতটা লাগবে বুঝতে না পেরে বাজিটা লড়েছিল।
আর এই একই কারণে, আমাদের তুঘলক মিঞা খোরাসানের পরিস্থিতিটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেন নি। হিসেবে কিছু গলদ থেকে গিয়েছিল। আসলে এটাই মজা। জিন্- গত কারণে আমরা কিছু জিনিস আগের থেকেই শিখে আসি। যেমন খিদে পেটে যে কোন খাওয়ারই ভালো লাগে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মই এই যে আমরা আমাদের নানাবিধ ব্যাবহারের মাধ্যমে সেই বিধির বিধান পরিবর্তিত করতে পারি এবং সেই ব্যবহার আর তার উপলব্ধ ফল যাচাই করে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি।
কার্টুন : কুণাল চক্রবর্ত্তী