গাছ বলতে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনস্পতি অথবা দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ। আপাত দৃষ্টিতে গাছ কে নিরীহ মনে হলেও তা যে সত্যি নয় সেটা কিছু কিছু কল্প বিজ্ঞানের গল্পে বা সিনেমায় আমরা দেখেছি। তাছাড়া পতঙ্গভুক গাছেদের নাম ইতিমধ্যে কারো কারো মাথায় চলে এসেছে এতক্ষণে। গাছের গায়ে কাঁটা, বিষাক্ত রোঁয়া (যেমন, বিছুটি) এগুলো তাদের আত্মরক্ষার পরিচয় বহন করে। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তারা নানা “অস্ত্র-শস্ত্র” উঁচিয়ে সাবধান থাকে বিভিন্ন পশু-প্রাণীদের থেকে।
সুতরাং মলয় সমীরণে দুলকি দোলনরত গাছের পাতা-ডাল-ফুল দেখে কবিরা যতই উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করুন না কেন যুক্তি-বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে গাছ যথেষ্ট বাস্তববাদী ও কর্মনিষ্ঠ সে কথা বলাই যায়।
এ কথা বলার পর কেউ কেউ আমার পরবর্তী বাক্যবিন্যাসের প্রতি “উন্নাসিক” বিশেষণ ব্যবহার করে থাকেন। প্রথম প্রথম আমিও নিজেকে তাই ভাবতাম। যুক্তিটা এই রকম – “আরে মশাই, শুধু গাছ কেন ? যে কোন প্রাণশক্তিই নিজেকে বাঁচাতে সংগ্রাম করে। তাই বলে গাছকে আপনি হিংস্র বলতে পারেন না। ওরা তো নিজেদের মধ্যে কোন লড়াই করে না, যেমন অন্য পশুরা করে, মানুষ করে।”
প্রশ্ন যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ অর্থাৎ স্বজাতির দুই প্রতিদ্বন্দীর মধ্যে হয় তাহলে হয়তো একই ক্লাসের ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার লড়াই বলা যায়। দুজনের খাতা-বই-সিলেবাস ও প্রশ্নপত্র একই। সেক্ষেত্রে “হিংস্র” শব্দ অভিধানে তুলে রাখাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু পরিকল্পিত রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগে সংঘবদ্ধ একটি প্রজাতি যখন অন্য প্রজাতিকে ধ্বংস করে সাম্রাজ্য বিস্তার করে তখন তার মধ্যে “হিংসা”-র ছাপ স্পষ্ট, আর এই বিশেষ প্রক্রিয়াকে “অ্যালেলোপ্যাথি” বলা হয়।
“অ্যালেলোপ্যাথি” হল গাছেদের পারস্পরিক অস্তিত্ব রক্ষার পদ্ধতি। এক রাসায়নিক পদার্থ “অ্যালেলোকেমিকল্”, যার ব্যবহারে গাছ অন্য প্রজাতির গাছের পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে অনিষ্ট করে এবং নিজেদের প্রজাতির গাছকে সাহায্য করে। সূর্যমুখী গাছের পাতায় এই ধরনের রাসায়নিক পদার্থগুলোকে হেলিয়ানল নামে চিহ্নিত করা হয় আর কালো আখরোটের কুঁড়ি, মূল ও ফলের আবরণে জাগলোন থাকে। তাছাড়া ইউক্যালিপ্টাস, ধান, গম, শশা, কালো সরষে ইত্যাদি গাছেরা নিজেদের শরীর থেকে নানা রকমের “অ্যালেলো” রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। রাসায়নিক পদার্থ গুলো সাধারণত ফেনলিক অ্যাসিড, ক্যুমারিন, টারপিনয়েড, ফ্ল্যাভনয়েড, অ্যালকালয়েড, গ্লাইকোসাইড, আইসোথায়োসায়ানেট বা গ্লুকোসিনোলেট প্রভৃতি ধরনের হয়ে থাকে। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত “দ্য এফেক্ট অফ প্লান্ট টু ইচ আদার” বইটিতে এ বিষয়টি প্রথম বিশ্লেষণ করেন অস্ট্রিয়ান অধ্যাপক হান্স মলিস এবং “অ্যালেলোপ্যাথি” শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে গাছ এই সব রাসায়নিক পদার্থ নির্গমন করে, যথা পাতা দ্বারা নির্গত বাষ্প, গাছ ধোয়া জল, মূল, গাছের জীর্ণ-পচা অংশ, বীজের নির্যাস ইত্যাদি।
বাড়ির ছোট্ট বাগানে বাজার থেকে কেনা কয়েকটি গাঁদা চারা লাগালাম। কদিন যেতে না যেতে দেখি আরো কত নাম না জানা আাগাছা জন্মে গেছে। এই সব অলীক গাছ গুলোকে আপনি তুলে ফেলুন, দেখবেন আবার হচ্ছে। ভদ্রতার খাতিরে যদি তা না করেন তাহলে আপনার “বাবুসোনা” গাঁদা চারাটি আপনার চোখের সামনে অপুষ্টিতে রুগ্ন “প্যালা”-র মত ফ্যালফ্যাল করে বাকি শীতকাল আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
কিছুদিন আগে “প্রসিডিংস্ অফ দ্য রয়াল সোসাইটি বি” (জানুয়ারী ৭, ২০১৪) পত্রিকায় একটি গবেষণা পত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে, ফিজি দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্র উপকূলে একটি কোরালের উপস্হিতিতে সেখানকার বিশেষ প্রজাতির সামুদ্রিক “আগাছা” গুলোর বিষাক্ত কোরাল ধ্বংসকারী “অ্যালেলোকেমিকল্” নির্গমনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এহেন রাসায়নিক যুদ্ধে সামুদ্রিক “আগাছা” গুলির সামগ্রিক বৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে আর নিরামিষাশী মাছেরা এগুলির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বেশি পরিমাণে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এই গবেষণাটি কোরালের উপস্হিতিতে সামুদ্রিক “আগাছা”-দের “অ্যালেলোকেমিকল্” বৃদ্ধির ঘটনাটি সামনে আনে। যদিও সামুদ্রিক আগাছাদের এই আচরণটি সাধারণ, নাকি বিশেষ, তা গবেষণা সাপেক্ষ বলে দাবী করেছেন ওই বিজ্ঞানীরা। সাধারণত গাছেরা একটি নির্দিষ্ট আচরণ বিধি মেনে চলে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কোরালের উপস্হিতিতে “সামুদ্রিক-আগাছা”-দের নাটকীয় রূপ-বদল চোখে পড়ার মত বিষয়।
বর্তমানে বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা আাগামী ভবিষ্যতে বাস্তুতন্ত্র সুস্হিত করার লক্ষ্যে যদি এই “অ্যালেলোকেমিকল্”-কে ব্যবহারিক প্রয়োগ করে পৃথিবী থেকে চিরতরে “কৃত্রিম রাসায়নিক আগাছানাশক” গুলোকে বর্জন করা যায়, ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের টিকা দেওয়ার মত করে ভাবা যেতে পারে।
এবার ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন ব্যাপারটা। গাছেরা কেমন চুপচাপ আপনার-আমার সামনে দিব্বি হাওয়ায় ডাল-পাতা দোলাতে দোলাতে পাশের গাছটির শ্রাদ্ধর আয়োজন করে। অথচ আমরা ভাবি, কী নির্বোধ! গাছ যদি চলতে-হাঁটতে পারতো তাহলে কথায়-কথায় তার ডাল ভাঙা, পাতা ছেঁড়া আর গাছ কাটার উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চই দিত, দিতই।
ছবি : তন্ময় দাস (টাটা ইন্স্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, মুম্বাই)