আমার বাড়ির উল্টো দিকে যে মুরগীর মাংসের দোকান আছে তার মালিক কখনই মনে করেন না যে আমি কোনো কাজের কাজ করি। এমন অনেকবার হয়েছে যে অফিস থেকে ফেরার পথে তার কটু মন্তব্য এসেছে আমার কানে -“ কী সব বিজ্ঞান-বিজ্ঞান যে করে এই ছেলেটা!
কী হয় এসব করে ?” বলা বাহুল্য, আমি কোনো তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হইনি তার সঙ্গে। এলাকার যে স্কুলে পড়েছি আমি, তার ভূগোলের শিক্ষকও কোনো দিন মনে করেননি যে আমার কাজের কোনো মূল্য আছে! চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে যত বার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে , তিনি অবজ্ঞাই প্রকাশ করেছেন। পাড়ায় নাট্য অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক বলে পরিচিত যে ছেলেটা, নিজের দাবিতে যে সব সময় প্রগতিশীল, নাটক ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে দু’কথা শোনার বা পড়ার আগ্রহ নেই যার – তারও মনোভাব একই রকম। কী হয় এসব করে ? নাটুকে ছোকরার কলকাতাবাসী গুরু বা অন্যান্য নাট্যবেত্তারা সুযোগ পেলেই বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতির জয়গাণ করেন। কিন্তু তাঁদের আচরণ দেখে এ ছোকরা শিখে গেছে যে বিজ্ঞানের প্রতি মনোযোগ না দিয়েই বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া যায়! তাই সে অনায়াসে বলতে পারে , “বিজ্ঞান-টিজ্ঞান কঠিন ব্যাপার , ও কি আর বেশি লোক শোনে নাকি ?”
এর সঙ্গে রয়েছে মাধ্যমের প্রতি অবহেলা। এ কথা কে না জানে যে টেলিভিশন আসার পর রেডিও-র কদর গেছে কমে। সেটা যে শুধু এদেশে ঘটেছে তা নয়, ঘটেছে সর্বত্র। এর সঙ্গে আকাশবাণীর কারিগরী বিভাগের দুর্বলতা রেডিও শোনার ব্যাপারটাকে প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এফ.এম. সম্প্রচার এসে অবস্থার সামাল দিল কিছুটা। ঝকঝকে সম্প্রচার শুনে মানুষ নিজে থেকেই আলাদা করে নিল দুটোকে – “রেডিও তো এখন আর কেউ শোনে না, এফ.এম.-টাই শোনে!” দুটোই যে বেতার যন্ত্রের উপহার সেটা কে বোঝাবে ?! আগেকার মিডিয়াম ওয়েভ সম্প্রচারের সঙ্গে জুড়েছে এফ.এম. , পার্থক্য এইটুকুই। আমি যখন রেডিওর চাকরিতে ঢুকি তখনও এফ.এম. আসেনি, ছিল কেবল অবাঞ্ছিত আওয়াজের ভারে নুয়ে পড়া মিডিয়াম ওয়েভ বা এ.এম.। ফলে সেই অবস্থায় আমাদের আত্মীয়রাও মন্তব্য করতে ছাড়ত না – “ আমার রেডিও সেটটা তো খারাপ হয়েই আছে কত দিন। মহালয়ার আগে একবার সারিয়ে নেবো। তা ছাড়া তো দরকার হয় না।” আমার সহপাঠী, পদার্থবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র অধ্যাপক আনন্দ দাশগুপ্ত আমার চাকরির কথা শুনে তড়িঘড়ি অভিমত দিয়েছিলেন – “ওখানে জয়েন করেছিস ? ওই যেসব প্রোগ্রাম কেউ শোনে না, তার দায়িত্বে?” আমাদের আলোকবিজ্ঞান পড়াতেন যে অধ্যাপক , যাঁর মতে জীবনের একমাত্র পরিণতি রিসার্চ স্কলার হওয়া বা লেকচারার হওয়া, তিনি শুনে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন।
এই চরম বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই পথ চলা শুরু আমার। বেতারে বিজ্ঞান প্রচারের পথ। সেখানে প্রথম পাঁচ বছর কেবল মিডিয়াম ওয়েভের জন্য অনুষ্ঠান করেছি। তারপর এলাম আমাদের অধিকর্তা ডক্টর অমিত চক্রবর্ত্তী-র সংস্পর্শে। ততদিনে এফ.এম. তরঙ্গ ভাসতে শুরু করেছে। সেখানে খ্যাতিমান শিল্পীদের উচ্চারণ শোনা যায়, তাঁদের কন্ঠে নাটক, আবৃত্তি, গান ভরিয়ে রাখে সময়। বাংলার পাশে হিন্দী গানও থাকত। জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে কয়েকটি বানিজ্যিক সংস্হাও সময় কিনে গান বাজাত এফ.এম.-এ।
অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সেখানে সম্প্রচারের একমাত্র শর্ত ছিল বিনোদন। সেখানেই বিজ্ঞানের অনুষ্ঠান অল্প অল্প করে শুরু করার পরামর্শ দিলেন অমিতদা। শুরুও করলাম, বিকেলের অনুষ্ঠানে। নেহাত অধিকর্তা বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষ, না হলে এফ.এম. প্রচারতরঙ্গে বিজ্ঞান বলার সুযোগ আকাশবাণী দিত কিনা তা নিয়ে আজও যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। প্রথম দু’কয়েকটা অনুষ্ঠান কিন্তু ভালো হল না। শ্রোতাদের কেমন লেগেছিলো জানি না, আমি তৃপ্ত হতে পারিনি। এভাবেই টুকটাক অনুষ্ঠান করে শক্ত করলাম নিজের জমি। তারপর ১৯৯৯ সাল থেকে একেবারে ধারাবাহিক ভাবে শুরু করলাম আমার অনুষ্ঠান ” বিজ্ঞান রসিকের দরবারে “। পাক্ষিক অনুষ্ঠান, নামকরণ নিয়ে ভেবেছি অনেকদিন। প্রেম-ভালোবাসা- ভ্যালেন্টাইন-বিরহ জাতীয় রস যে আমার অনুষ্ঠানে থাকবে না সে তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমার চিরদিনের বিশ্বাস বিজ্ঞানের নিজস্ব একটা রস আছে যা দিয়ে মানুষকে মজানো যায়। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে ঊরু চাপড়ে আড্ডা দেওয়া যায় বিজ্ঞান নিয়ে। যেমনভাবে উত্তমকুমার বা অমিতাভ বচ্চন নিয়ে মাতোয়ারা হওয়া যায় আলোচনায় তেমনি বুঁদ হওয়া যায় বিজ্ঞানের খুঁটিনাটিতে। কোথা থেকে এলো বিশ্বাসটা ? অবশ্যই ইতিহাস থেকে। সে ইতিহাসে কার্ল সাগান যেমন আছেন তেমনি আছেন বরাহমিহির। বাঙালির রক্তে এই আড্ডা রয়েছে। তার মূলে কেবল রেনেসাঁ কিনা তা বলতে পারব না। আমার বিশ্বাস আর উৎসাহের আর একজন উৎস ছিলেন আমার বাবা। এফ.এম.-এ প্রথম অনুষ্ঠান করার আগেই অবশ্য বাবা প্রয়াত হন। আমার জন্য রেখে গেলেন … না তেমন কোনো শিক্ষা নয় , বাবা শিক্ষাবিদ ছিলেন না। রেখে গেলেন একটা স্পিরিট , এই স্পিরিটের বাংলা কী হবে ? যাই হোক্ , সে স্পিরিটের মূল কথা নির্ভীকভাবে যে কোনো বিষয়কে ভেঙে, টুকরো করে বুঝতে চাওয়া। বিষয়টা যেমন বিজ্ঞানের হতে পারে তেমনি হতে পারে রাজনীতি- অর্থনীতির। বাবা বলতেন, গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপের কথকের শৈলী অনুকরণীয়। কীভাবে একদল মানুষকে মোহিত করে রাখতে পারেন তিনি। এটা অন্য প্রসঙ্গ যে তার কথা বলার বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ম। নিজে নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন বলেই কিনা জানি না, কথোপকথন এবং বাচনভঙ্গী নিয়ে ভাবার চেষ্টা করতেন নিবিড়ভাবে । কিছু উত্তরাধিকার তো আমার মধ্যে বর্তাবেই !
প্রথম দিন থেকেই যে ” বিজ্ঞান রসিকের দরবারে ” হিট্ তা বললে মিথ্যে বলা হবে। রেকর্ড করা বিজ্ঞানের অনুষ্ঠান শুনেছেন প্রবীণ শ্রোতারা, আকাশবাণীর বিজ্ঞান সম্প্রচার নিয়ে তাও কিছুটা জানেন এঁরা। নবীন প্রজন্মের কাছে মিডিয়াম ওয়েভের কোনো অস্তিত্ব-ই নেই। তারা এফ.এম. মানে বোঝে “মস্তি”। সেখানে বিজ্ঞান পরিবেশনার জন্য কিছু পরিচিত কৌশল নেওয়া হল। ক্যুইজ ব্যাপারটা জনপ্রিয় এমনিতেই , তাতে আমার কিছুটা দক্ষতাও আছে। প্রথমে ক্যুইজ দিয়ে চেষ্টা হল তথ্য পরিবেশনের। বিজ্ঞানীদের জীবন সরসভাবে পরিবেশন করতে পারলে মানুষ আকৃষ্ট হয়। সেলিম আলি থেকে মেরি ক্যুরি – আলোচিত হল অনেকের কথাই। সঙ্গে রইল বিতর্ক। বিশেষ করে কুসংস্কার নিয়ে। সাধারণভাবে বিজ্ঞান কর্মীরা কোনো একটা কুসংস্কারকে তুলে ধরে খুব গালমন্দ করেন। তাঁদের ধারণা এতেই মানুষ কুসংস্কার ত্যাগ করবে। ভুল! মানুষের নিজের মনে কুসংস্কারের সপক্ষে কিছু যুক্তি জমা থাকে। তাকে সেগুলো বলার সুযোগ দিলে বেরিয়ে আসে যুক্তিগুলো, তখন ধীরে-ধীরে সেগুলোকে কাটা যায়, সামান্য হলেও তার মনে সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটানো যায়। এটুকুই বিজ্ঞান প্রচারের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ বলে আমরা মনে করি। একবার সহ-উপস্থাপক আর আমি ফেং শ্যুইয়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি রাখলাম। বিতর্ক জমাতে কিছুটা অভিনয়-ও করলাম। আমাদের ফোন-ইন সুবিধে আছে। শ্রোতারা এসে পক্ষে-বিপক্ষে যোগ দিলেন। তারপর একসময় বিতর্ক থামিয়ে ফেং শ্যুইয়ের উৎপত্তি, চীনে তার কুৎসিত প্রভাব বর্ণনা করলাম। ফলে যারা দোটানায় ছিলেন তারা বুঝলেন ব্যাপারটা। এর একটা অভাবনীয় ফল দেখলাম পরের দিন। আমাদের এলাকার এক স্বাস্থ্যকর্মী দিদি এসে জানিয়ে গেলেন তিনি অনুষ্ঠানটা শুনেছেন এবং শোনার পর একটা কাজ করেছেন। ফেং শ্যুই বিশেষজ্ঞের মত অনুযায়ী যে স্ফটিক গোলক কিনেছিলেন তিনি তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন! সত্যিই এক বড় সাফল্য ! আমি ফোনে খ্যাতিমান জ্যোতিষীদের আহ্বান করে বিতর্কও করেছি, সেটাও ‘হিট্’ ! তবে হ্যাঁ, তার আগে জ্যোতিষের খুঁটিনাটি পড়ে নিতে হয়েছে আমাকে।
এগুলো যখন চলছে তখন ভীরু কন্ঠে বিজ্ঞানীদের কাছে বলার চেষ্টা করেছি – কিছু একটা করছি। দুঃখের বিষয়, কলকাতার অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা এসব ব্যাপারে নিস্পৃহ। তবে জীববিজ্ঞানী প্রণবেশ সান্যাল খুব উৎসাহ দিতেন। তিনি তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন। একজন চিকিৎসক, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেবাশিষ বসু একবার নিজে উদ্যোগ নিয়ে একগোছা জেরক্স করা কাগজ দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের দপ্তরে। এই বৈপরীত্য দেখে তাক্ লেগে যেত। বিজ্ঞানীদের সরাসরি স্টুডিওতে উপস্থিত করতে গিয়েও কম অপমান সইতে হয় নি ! একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক-প্রশাসক তো মুখের ওপর বলে দিলেন যে মাঝরাতে কয়েকজন নিদ্রাহারা, পাগলের সঙ্গে ফোন-আলাপ করতে তিনি আসবেন না। এটা মানি শ্রোতারা অনেক সময় অবান্তর কথা বলেন। আসলে তারা তো আর বিজ্ঞানী নন। একটা বড় অংশ রয়েছে যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা চেষ্টা করে প্রাসঙ্গিক কথা বলতে। কিন্তু বাকিরা ? অনেক সময় কৌতুক ব্যবহার করে, কখনো কিছুটা কড়া হয়ে এদের মনেবীণার তার “টিউন” করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভুললে চলবে না এরাও আমাদের শ্রোতা। বলা ভালো, লক্ষ্য এরাও !
কটু কথা বলার পরেও কেউ-কেউ এসেছেন স্টুডিওতে। ফিরেছেন মুগ্ধ হয়ে। আজও অনেক বিজ্ঞানীর ধারণাই নেই ” বিজ্ঞান রসিকের দরবারে “-তে কত গভীর প্রশ্ন আসে ফোনের তার বেয়ে! কত ছাত্র-ছাত্রী যে স্রেফ এই অনুষ্ঠান শুনে বিজ্ঞানে আগ্রহ ফিরে পেয়েছে তার পুরো হিসেব নেই আমার কাছে।
এই অনুষ্ঠানকে পনেরো বছর ধরে চালানো বোধহয় সহজ কাজ ছিল না। আজও অনেকের ভাব এই রকম – তুমি কি বিজ্ঞানের সব কিছু জানো ? আমার পাল্টা প্রশ্ন, কে জানে সবকিছু ? আমার দেড় দশকের প্রয়াস ছিল এই লাইভ অনুষ্ঠানকে বিজ্ঞান আলোচনার একটা প্ল্যাটফর্মে পরিণত করার। তার সূচনার দয়িত্ব নিতে হয়েছে নিজেকে। ইন্টারনেট্ অধ্যয়নের দিগন্ত প্রসারিত করে দেওয়ায় সুবিধে হয়েছে অনেক। তবে অনুষ্ঠানের সাফল্যের মূলে শেষ কথা অবশ্যই বাচনভঙ্গী। আড্ডার ছলে কঠিন কথাকে সহজ করে ফেলা। আমাদের পাড়ায় বিয়ে হয়ে আসা এক ভদ্রমহিলা আমার স্ত্রী-কে বলেছিলেন, “অনুষ্ঠান শুনতে-শুনতে মনে হয়, এভাবে পড়ালে আমিও বিজ্ঞান পড়তাম। আমিও ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম।” পুরস্কার হিসবে মন্দ নয় মন্তব্যটা, কী বলেন ?!