এই প্রবন্ধের লেখক এবং যাদের লক্ষ্য করে লেখা সেই পাঠকদের সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া ভালো। লেখকেরা স্কুল-এর গন্ডি পার করেছে ১০-১৫ বছর বা তার বেশি সময় আগে, আর পাঠকেরা এখন তাদের জীবনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়ে, তাদের স্কুল জীবনে। এই ১০-১৫ বছরে আমরা দেখছি চারিদিকে এক চরম পরিবর্তনের রেস। কিসের পরিবর্তনের কথা বলছি?
প্রাথমিক ভাবে: প্রযুক্তি বিদ্যার অগ্রগতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রযুক্তি বিদ্যার উদাহরণ সরূপ সবচেয়ে প্রথমে বলতে হয় আজকের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা (মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদি)। আজকের দিনের অনেক স্কুল পড়ুয়া এই একটা বিষয়ে সৌভাগ্যবান**, যদিও গ্রামের আরো অনেক ছাত্র আছে যারা এখনো এই সুযোগকে যথেষ্ট পরিমানে গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না। আমাদের এই ‘বিজ্ঞান’ বর্তমান প্রযুক্তির মাধ্যমে স্কুল পড়ুয়াদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
আমাদের যদি প্রশ্ন করা যায়, বিজ্ঞান ভালো লাগত কেন ? নিজের স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একটা শব্দে উত্তর দেব : মজা। বিজ্ঞানের মজা অনেকটা যেন ম্যাজিকের মতই উপলব্ধি করেছিলাম। অনেক ছোট ছোট বিজ্ঞানের পরীক্ষা হাতে-নাতে নিজে করার একটা আনন্দ। এইরকম অনেক ছোট ছোট পরীক্ষা না হয় পরে কোনো প্রবন্ধে সবিস্তরে লেখা যাবে। মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে। তখন থেকেই আমাদের পূর্ব পুরুষদের অনেক প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হেয়েছে। উদ্ভাবনী শক্তি এবং অজানাকে জানার অসীম কৌতুহল সম্বল করেই আমাদের পূর্বপুরুষরা আজকে সফল হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির পিছনে প্রায় সর্বদা অজানাকে জানার একটা অনুপ্রেরণা কাজ করে। আর সেই সাথে থাকে মানব কল্যাণের তাগিদ ।
স্কুলে প্রবেশ করে একটা বিষয়ে সবাই একমত যে পড়াশোনা করা দরকার। কিন্তু কি কি বিষয়ে পড়াশোনা করব এবং কেন করব? সমস্ত বিষয়গুলিকে তাদের নিজস্ব কারণের জন্য চর্চা করা দরকার। বিজ্ঞান যত উন্নত হতে শুরু করেছে তত তার নতুন নতুন শাখা তৈরী হয়েছে। এটা আমরা স্কুল জীবনেও উপলব্ধি করে থাকি। আমরা যখন স্কুল-এ পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন বিজ্ঞান বলতে কেবল একটি বই-এর কথাই জানতাম। তার পর যত বড় ক্লাস-এ উঠি তত তা ভাগ হতে থাকে- ভৌত বিজ্ঞান, জীবন বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ইত্যাদি। আরো উঁচু ক্লাস-এ আমরা দেখি যে এই প্রত্যেকটি আবার বহু ভাগে বিভক্ত। বিজ্ঞানের এই অসীম ব্যাপ্তির কারণে আমরা যারা বিজ্ঞান চর্চা করতে আগ্রহী হই তাদের যেকোনো একটি বা দুটি শাখা পছন্দ করতে হয়। কিন্তু আমরা বুঝব কেমন করে যে এটাই আমার পছন্দর বিষয় ? তার জন্যে একটা সময় দরকার, যে সময়ের মধ্যে আমরা বিজ্ঞানের অনেক গুলি শাখা সম্বন্ধে কিছু কিছু ধারণা করতে পারি। সেইজন্যে স্কুল জীবনে আমাদের বিজ্ঞানের সমস্ত বিষয় এমনকি বিজ্ঞান বহির্ভূত আরো অনেক কিছু যেমন সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল-ও পড়া প্রয়োজন। স্কুল-এ যখন আমরা বিজ্ঞানের চর্চা করি তখন আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এমন কিছু কিছু বিষয় পড়ছি যেগুলো কোনদিন কাজে লাগবে না। কিন্তু যত উচ্চ-শ্রেণীতে উঠব তত দেখব যে নিচু ক্লাস-এর প্রত্যকটি বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে নানান ভাবে প্রভাবিত করে। এমনকি, তার সাফল্যের উপর সরাসরি নির্ভর করে অনেক মানুষের ভাগ্য। জলবায়ু ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণীতে ব্যর্থ হলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। ইদানিং আবহাওয়া বিজ্ঞানের উন্নতির হাত ধরে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা আমরা আগে থেকে জেনে যাচ্ছি, তেমনি সেই বিজ্ঞানই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পৃথিবীর জলবায়ু ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে। প্রতিবছর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা একটু একটু করে বেড়ে চলেছে (যাকে global warming বলে)। বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি এর জন্যে দায়ী। পৃথিবীকে বাঁচাতে গেলে পরিবেশ দূষণ আটকাতে হবে এখনই। সেই জন্য গাছপালা এবং বন জঙ্গলের সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ গাছপালাই সালোক সংশ্লেষের সাহায্যে বাতাসে অক্সিজেন ও কার্বণ ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য বজায় রাখে।
এই সালোক সংশ্লেষই আবার সৌর শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে, যা পরবর্তীকালে আমরা খনিজ জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করি। কিন্তু একদিন তো এই জমানো শক্তি শেষ হবে, তার জন্য আমাদের চাই বিকল্প শক্তির উৎস। যেমন আমরা অনেকে সোলার সেল-এর নাম শুনেছি যার কাজ হলো ঠিক সালোক সংশ্লেষের মত সৌর শক্তিকে সরাসরি বৈদুতিক শক্তিতে রুপান্তরিত করা। কিন্তু মানুষের তৈরী সোলার সেল এখনও প্রকৃতির সালোক সংশ্লেষ এর তুলনায় তুচ্ছ। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, প্রকৃতির সালোক সংশ্লেষ কে ঠিকভাবে অনুকরণ করা সম্ভব কি? তাহলে আজকের শক্তির সমস্যা এবং তার সাথে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমস্যারও সমাধান হতে পারে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য দরকার বিজ্ঞানের একাধিক শাখার জ্ঞান (inter-disciplinary research)- ভৌত বিজ্ঞান, জীবন বিজ্ঞান আবার রসায়ন।
বিজ্ঞান পড়ে যেমন আমরা কুসংস্কার থেকে মুক্ত হই, তেমনি বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোই আমাদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলে। আমাদের জীবন যাতে আরও উন্নত হয় তার জন্য বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করেন।
বিজ্ঞানের গবেষণাকে অনেকে দুভাগে ভাগ করেন- মৌলিক গবেষণা (fundamental research), আর ব্যবহারমূলক গবেষণা (applied research)। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকালে একটা মজার জিনিস দেখতে পাব- তা হল অনেক সময় বিজ্ঞানের নানান জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এমন সব প্রযুক্তি বেরিয়ে আসে যা মানুষের জীবন পালটে দেয়। একটা উদাহরণ দিই- কিছুদিন আগে খবরের কাগজে হয়ত তোমরা পড়েছ যে বিশ্বজোড়া হাজার হাজার বিজ্ঞানী মিলে স্যুইজারল্যাণ্ড আর ফ্রান্সে জড় হয়েছে একটা নতুন কণা খুঁজে পাওয়ার জন্য, যাকে বলে হিগস কণা (অনেক খবরের কাগজে আবার তার নাম বেরিয়েছে ঈশ্বর কণা, যদিও ঈশ্বরের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই!)। এখন তোমরা তো প্রশ্ন করতেই পার যে কোটি কোটি টাকা খরচ করব কেন প্রকৃতিতে কোন কণা আছে কিনা তা জানতে। পৃথিবীতে এত গরীব মানুষ আছে – গবেষণার ঐ টাকা অন্য কাজে ব্যয় করলে ভাল হয় না কি? খুব সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু একটু খোঁজ নিলে জানতে পারব যে এই ধরণের গবেষণা খালি কিছু বিজ্ঞানীর কৌতুহল মেটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এর থেকে অনেক প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। যেমন, এই পরীক্ষার সাথে যুক্ত বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে তথ্যের সহজ আদান প্রদানের জন্য তৈরী হয়েছিল ইন্টারনেট অথবা World Wide Web (www)। আর এখন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা থেকে ট্রেনের টিকিট কাটা – সেই ইন্টারনেটই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আবার, চিকিৎসা শাস্ত্রে এখন এমন অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার হয় যার আবির্ভাব সেই মৌলিক কণার গবেষণা থেকে। ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় এবং রোগ নির্ণয়ে যে রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় তার প্রযুক্তির উদ্ভাবনও হয়েছে এই মৌলিক গবেষণার সাথে সাথে।
সমাজের এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞান মনস্কতা খুব জরুরী। খালি বিজ্ঞানীদেরই বিজ্ঞান পড়লে বা ভাবলে চলবে না, সবাইকে এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। এই যে হিগস কণার পরীক্ষাটিতে কোটি কোটি টাকা লাগল, সেই টাকা তো আসবে সাধারণ মানুষের দেওয়া খাজনা থেকে। বিজ্ঞানীরা কত টাকা পাবে তা ঠিক করবেন সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা যারা বাজেট তৈরী করেন। তাই সাধারণ মানুষ, যারা বিজ্ঞানী নন, তাদের জানা উচিৎ তাদের টাকা কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে, আর যারা বাজেট তৈরী করেন তাদেরও জানা উচিৎ এই পরীক্ষাটি করলে সমাজের কি লাভ হতে পারে। আর এই সব জানার একমাত্র উপায় বিজ্ঞান পড়া, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের খবর রাখা, আর তা নিয়ে আলোচনা করা।
** কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রত্যেক প্রযুক্তির যেমন ভালো দিক থাকে তেমনি তার একটা অন্ধকার দিকও থাকে। এটা লক্ষ্যনীয় যে আজকের দিনে পড়াশোনার পাশা পাশি ছাত্রদের খেলা ধুলার টান অনেক কমে গেছে। খেলার সময়টা এখন অনেকটাই এই প্রযুক্তি-বিদ্যার শিকার হয়েছে। আরো একটা দিকে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন সেটা হলো ইন্টারনেট থেকে নকল করার প্রবণতা যা বর্তমান স্কুল পড়ুয়াদের ওপর খুব খারাপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
সহযোগিতায়: রাজীবুল ইসলাম এবং অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়, ছবি: জয়ন্ত মন্ডল।