৩.
সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বৃহৎ কিছু না হোক, ছোটোখাটো অনেক কিছু ঘটনাই ঘটেছে। অনেক কাল আগের কথা, অনেক কিছুই ভুলে গেছি – যেগুলি মনে আছে তারই দু-একটি ঘটনার কথা বলছি।
১৯২১ সালের প্রথম দিকে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে প্রবেশ করি। আমার কাছে সে এক অভিনব পরিবেশ। বর্তমানের তুলনায় বিজ্ঞান মন্দিরের আড়ম্বর ও কর্মীসংখ্যা তখন অনেক কম থাকলেও, প্রথম দিকটায় কেমন যেন একটু হকচকিয়ে গেলাম। সবার মুখেই শুনি কেবল বড় সাহেব আর নাগ সাহেব। কর্মীদের মধ্যে যা কিছু আলাপ-আলোচনা , তার অধিকাংশই ওই দুটি নামকেই কেন্দ্র করে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত মনে হয়েছিল। দু-চার জন ছাড়া অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল। প্রথম কিছুকাল পর্যন্ত আমাকে কোন নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এরপর জগদীশচন্দ্র আমাকে একদিন দেকে বললেন – ওদের (গবেষণা- কর্মীদের ) সঙ্গে কাজকর্ম দেখ এবং শিখতে চেষ্টা কর। এ ছাড়া ক্কচিত কখনও দু-একটা কথা হয়েছিল মাত্র। অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গেও খুব সংক্ষিপ্তভাবে দু-একটা কাজের কথা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে তাঁকে আলাপ-আলোচনা করতে দেখি নি। সর্বদাই তিনি একটা গাম্ভীর্যের ভাব রক্ষা করে চলতেন। অসতর্ক মুহূর্তে কোন একটা হাসির কথা বলেই হেসে ফেলতেন বটে, কিন্তু অন্যান্যরা সেই হাসিতে যোগ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি গম্ভীর হয়ে যেতেন। কারোর কোন কাজের বিরক্তির কারণ ঘটলে সামনা-সামনি বিশেষ কিছু না বলে – হয় নাগ সাহেব (সহকারী অধ্যক্ষ প্রোফেঃ নগেন্দ্রচন্দ্র নাগ ) নয়তো সমবেত কর্মীদের কাছে তর্জন-গর্জন করতেন। আর একটা অভ্যাস ছিল, কোন কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘুরে ফিরে এসে অনবরত তাগিদ দেওয়া। এর ফলে অনেক সময় কাজের পরিবর্তে অকাজই হতো অথবা অযথা বিলম্ব ঘটতো। কারণ তাঁর সান্নিধ্যে সবাই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়তো। অতি সাধারণ একটা ঘটনার কথা বলছি। এ থেকেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
তাঁর প্রায় সব কাজেই দেখেছি – শেষের দিকেই তাড়াহুড়া পরে যেতে। একখানা বইয়ের পান্ডুলিপি বিলাতে পাঠাবেন। অনেকদিন ধরেই লেখা আর টাইপ করা চলছে। ডাকযোগে বিদেশে যেত সপ্তাহে মাত্র একদিন। জেনারেল পোস্ট অফিসে বিদেশী পার্শেল গ্রহণের শেষ সময় ছিল নির্ধারিত দিনের সাড়ে চারটা পর্যন্ত। ডাকের শেষ দিনেই পান্ডুলিপিতে কিছু নতুন সংশোধন ও সংযোজনের পর কয়েকটা পাতা পুনরায় টাইপ করতে দিয়েছেন এবং পাশের ঘরে টাইপিস্টকে ঘন ঘন তাগিদ দিচ্ছেন। বারান্দায় ছোট টেবিলটার উপর সূচ-সূতা, মোম-কাপড়, আঠার বোতল, শিল-মোহর, গালা প্রভৃতি নিয়ে নাগ সাহেব ও নিশিবাবু [ নিশিকান্ত বল ] প্রস্তুত হয়ে আছেন। আমিও একপাশে দাঁড়িয়ে আছি, যদি কোন দরকার হয় ! দেয়াল-ঘড়িটার কাঁটা তখন দুটার ঘর পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। জগদীশচন্দ্র হল ঘরটার মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। মাঝে মাঝে টাইপিস্টের কাছে যান, আবার বারান্দায় এসে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকান। সবারই মুখে একটা উদ্বেগের ভাব। যাহোক, আর মিনিট কয়েকের মধ্যেই টাইপ শেষ হলো। নতুন টাইপ-করা পাতার পিছনে আবার ছবি এঁটে দিতে হবে। নাগ সাহেব ছবিতে আঠা মাখিয়ে দিচ্ছেন, নিশিবাবু (সুপারিন্টেন্ডেন্ট ) ছবি আঁটছেন আর বোস সাহেব ( জগদীশচন্দ্র ) পেছনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। আমি তিনটা সূচে সূতো পরিয়ে রাখছি। ছবি আঁটা হয়ে গেলে বোস সাহেব তাঁর ঘরে চলে গেলেন। সবাই যেন একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু তখনই ধরা পড়লো- একটা ছবি উল্টোভাবে লাগানো হয়েছে। তাড়াতাড়ি ছবিটা তুলে নিয়ে ঠিক করে বসানো হচ্ছিল – ইতিমধ্যেই বোস সাহেব পুনরায় ফিরে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন – আর পনেরো-বিশ মিনিট মাত্র সময় আছে – এখনও হলো না ? বোস সাহেবের মুখ থেকে এই কথা কয়টি উচ্চারিত হতে না হতেই নিশিবাবু একটা অভাবনীয় কান্ড করে ফেললেন, যা দেখে আমরা তো বটেই, স্বয়ং বোস সাহেব পর্যন্ত – যাকে বলে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ – সেরূপ একটা অবস্থায় নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন।
নাগ সাহেব নিজের ফর্মুলায় আঠা তৈরি করে মোটামুখের একটা পাউন্ড বোতলে ভর্তি করে এনেছিলেন। ছবিতে আঠা মাখাবার পর সেই বোতলটা মুখ-খোলা অবস্থায় টেবিলের উপর বসানো ছিল। বোস সাহেবের পুনরাবির্ভাব এবং নৈরাশ্যব্যঞ্জক কণ্ঠস্বরেই বোধ হয় ঘাবড়ে গিয়ে হাত সরাতেই জামার আস্তিনে লেগে আঠার বোতলটা কাৎ হয়ে পড়ে গেল। বোতলের প্রশস্ত মুখ দিয়ে সেই তরল আঠা কাগজপত্র ভিজিয়ে টেবিলটার একদিক ভাসিয়ে অজস্র ধারায় মেঝের উপর পড়তে লাগলো। বোতলটাও গড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু নাগ সাহেব সেটাকে খপ করে ধরে ফেললেন। কিন্তু ধরলে কি হবে ! বোতলটার সর্বাঙ্গ আঠায় মাখামাখি, নাগ সাহেবের হাত ফসকে গিয়ে সেটা বোস সাহেবের পায়ের কাছে পড়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থেকে নাগ সাহেব দু-হাতে আঠা তুলে ভাঙা বোতলের তলার অংশটাতে রাখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার পর কোন কথা না বলেই বোস সাহেব তাঁর ঘরে চলে গেলেন। এই রকমের আরও দু-একটা ঘটনা ঘটবার পর কোন কাজ সমাপ্তির মুখে তাঁকে বড় একটা কাছে থাকতে দেখা যেত না।
যা হোক, জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে কর্মীদের অহেতুক ভীতির ভাবটা প্রথম প্রথম আমার কাছে যেন অদ্ভুত বলে মনে হতো। কারণ তাঁর কথাবার্তায় বা আচরণে এমন কিছু নজরে পড়ে নি, যাতে ভয় করবার মতো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির পর আমার মনেও যেন ওই রকমের একটা ভীতির ভাব ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করতে লাগলো। কিন্তু তাতে সুবিধা বা অসুবিধার কোন তারতম্য অনুভব করি নি। কারণ বিজ্ঞান সমর্কিত যে কোন কাজে আত্মনিয়োগ করাটাই ছিল আমার মুখ্য উদ্দেশ্য, অন্য সব গৌণ।
বিজ্ঞান মন্দিরের ভিতরে সবুজ ঘাসে ঢাকা মস্ত বড় একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আছে। পড়ন্ত বেলায় রোজই প্রায় ত্রিশ চল্লিশটা কাক এসে মাঠের মাঝ্কান্তায় জমায়েত হতো, মিহি-সুরের বিশ্রম্ভালাভ ছাড়া চেঁচামেচি বা গন্ডগোল করতো না। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই যে যার আস্তানায় ফিরে যেত আর সেখানে পড়ে থাকতো কতকগুলি খসেপড়া পালক। পরের দিন সকালে দেখা যেত, পালকগুলি মাঠময় সর্বত্র এখানে-ওখানে পতাকার মতো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হতো, কেউ যেন হাতে করে পুঁতে রেখেছে। মালীরা মাঠ পরিষ্কার করে – রোজই সেগুলিকে তুলে ফেলে দেয়, কিন্তু পরের দিন আবার সেই অবস্থা। দিনের পর দিন একই রকমের ব্যাপার ঘটতে দেখে প্রকৃত রহস্যটা জানবার জন্য খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়লাম। প্রোফেঃ নাগ থেকে আরম্ভ করে অনেককেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু অতি তুচ্ছ ব্যাপার বলে কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। অধিকন্তু প্রোফেঃ নাগ একটু বিদ্রূপের সুরেই বললেন – আপনি তো দেখছি বেশ ভাল একটা গবেষণার ‘প্রোবলেম’ পেয়ে গেছেন ! বেশ কিছুটা দমে গেলাম। দিন কয়েক এই বিষয়ে আর কিছু ভাবি নি। তারপর আবার সেই প্রশ্নটাই মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো – তুচ্ছ সমস্যারই যদি সমাধান না করা যায় তবে বৃহত্তর সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কোথায় ? অতএব ব্যাপারটা কী – খুঁজে দেখতেই হবে। দু-চারটে পালক তুলে দেখা গেল – প্রত্যেকটা পালকের সরু মুখের দিকটাই সরু সরু এক-একটা গর্তের মধ্যে ঢোকানো রয়েছে। সেগুলি যে কেঁচোর গর্ত, তাতে আর সন্দেহ রইলো না। কেঁচোই বোধ হয় পালকগুলিকে টেনে নিয়ে গর্তের মধ্যে ঢুকিয়েছে। সেদিনই কতকগুলি পরিত্যক্ত পালক সংগ্রহ করে মাঠের এক পাশে বাঁধানো চাতালটার কাছে সাজিয়ে রেখে দিলাম এবং রাত্রির অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই একটা টর্চ নিয়ে চাতালের উপর চুপটি করে বসে রইলাম। অনেকক্ষণ কেটে গেল কিছুই নজরে পড়ছে না। আরও কিছু সময় অপেক্ষা করবার পর একটা পালক যেন একটু নড়ছে বলে মনে হলো। অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু দেখা না গেলেও পালকের সাদা মুখটা যেন একটু ঘুরে গেল বোধ হলো। কিন্তু আর কিছুই লক্ষ্য করা সম্ভব হলো না। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করবার পর টর্চটা জ্বালতেই দেখি, প্রায় ৬।৭ ইঞ্চি লম্বা একটা কেঁচো কিলবিল করে ঘাসের তলায় ঢুকে পড়লো। পালকগুলি যেখানে সাজিয়ে রেখেছিলাম, একটা পালককে কেঁচোটা সেখান থেকে প্রায় ফুট দেড়েক দূরে টেনে নিয়ে গেছে। আলো জ্বালতেই সেটাকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। খসে-পড়া পালকের সরু মুখটায় শুকনো পর্দার মতো কিছু একটা পদার্থ লেগে থাকে। সেটা খাবার লোভেই রাত্রির অন্ধকারে কেঁচো পালকের সরু মুখটাকে ধরে টেনে নিয়ে গর্তের মধ্যে ঢোকাবার চেষ্টা করে। সরু মুখটা গর্তের মধ্যে ঢুকে গেলেও চওড়া দিকটার জন্য পালকের বেশীর ভাগই গর্তের বাইরে পতাকার মতো খাড়া হয়ে থাকে।
যা দেখেছিলাম প্রোফেঃ নাগকে বলতেই তিনি খুব খুশী হয়ে উঠলেন। প্রোফেঃ নাগের মারফতই বোধ হয় কথাটা জগদীশচন্দ্রের কানে গিয়েছিল। এই ব্যাপারের সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল কি না – জানি না, কিন্তু এর কিছুকাল পর থেকে তিনি মাঝে মাঝে প্রায়ই ডেকে পাঠাতেন এবং কাজকর্ম শিক্ষার বিষয়ে নানাপ্রকার উপদেশ দিতেন এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্বন্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আভাসও দিয়েছিলেন। একদিন ডেকে নিয়ে একটি যন্ত্রের অংশবিশেষ দেখিয়ে বললেন – একটা কোণ থেকে দেখলে যেমন দেখায় সেভাবে এই যন্ত্রটার একটা ছবি আঁকতে পার কিনা চেষ্টা করে দেখ ( চিত্রাঙ্কনে আমার কিছু অভ্যাস আছে, একথা পূর্বেই তিনি জেনেছিলেন )। কয়েক দিনের চেষ্টায় একটা ছবি তৈরি হলো। তিনি সেটার কিছু কিছু পরিবর্তন করে আঁকতে বললেন। এভাবে কিছুদিন পর্যন্ত আরও কিছু ছবি আঁকতে হলো। ছবি আঁকবার কাজ শেষ হবার পর তাঁরই নির্দেশে Perspective Drawing শেখবার জন্য Govt. Art School-এ ভর্তি হলাম। প্রথমত আমাকে প্রাথমিক শ্রেণীতে যোগদান করতে হয়েছিল। এখানে কয়েক সপ্তাহের জন্য মডেল ড্রয়িং করে পরবর্তী ক্লাসে যেতে হবে – ঐ ছিল আমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। কিন্তু প্রাথমিক শ্রেণী অতিক্রম করাই হলো আমর পক্ষে এক দুরূহ ব্যাপার। মধ্যস্থলে টেবিলের উপর একটা জাগ বা অন্য কোন মডেল বসিয়ে রেখে দেওয়ালের গায়ে টাঙানো বড় বড় ব্ল্যাকবোর্ডের উপর চক দিয়ে মডেলের আনুপাতিক হারে ছোট বা বড় ছবি আঁকতে হবে। শুধু মাত্র আউট লাইন – কিন্তু বোর্ডের গায়ে হাত না ঠেকিয়ে আঁকতে হবে। এভাবে ড্রয়িং করবার অভ্যাস আমার মোটেই ছিল না। চার সপ্তাহ কেটে গেল কিন্তু দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে যাবার ছাড়পত্র পেলাম না। অবশেষে সেই ক্লাসেরই একটি পরিচিত ছাত্রের সহায়তায় বিপদ উত্তীর্ণ হয়ে দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে উন্নীত হলাম। সেখানেও হাঁড়ি-কলসী-কুঁজোর মডেল। কিন্তু আঁকতে হয় কাগজ-পেন্সিলে। শেড দেবার অভ্যাস করতে হয়। এখানেও এলো আর এক বিপদ। শেডিং-এর গোলমাল হয়ে যায়। বেশ কিছুকাল চেষ্টার পর অপর একটি ছেলের ছবির অনুকরণে একটি মডেলের ছবি এঁকে মাস্টার মশায়ের কাছে পেশ করলাম। ছবিটি দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং পরবর্তী সপ্তাহেই উচ্চতর শ্রেণীতে যাবার ব্যবস্থা করবেন বলে ভরসা দিলেন। কিন্তু বরাতে দুঃখ থাকলে তা খণ্ডন করা সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ পরেই মাস্টার মশাই আবার আমার ড্রয়িং বইটি দেখতে চাইলেন। ছবিটিকে বারকয়েক ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখবার পর আমার বসবার সিটের কাছে উঠে এসে মডেলটার দিকে তাকিয়ে বললেন – তোমার ছবিটি খুবই ভালো হয়েছে বটে কিন্তু ইটা আসল নয়, অন্য কোন ড্রয়িং-এর নকল। নিশ্চয়ই তুমি নকল করেছ – কারণ তোমার সিট থেকে মডেলটি দেখে আঁকলে এর আউটলাইন এবং শেডিং এরকম হতে পারে না। অগত্যা আরও কিছুকাল সেখানেই কাটাতে হলো। আর্ট স্কুলের শিক্ষা সমাপ্তির পর আবার বইয়ের জন্যে ছবি আঁকা শুরু করলাম। [ জগদীশচন্দ্রের ১৯২৭-এ প্রকাশিত Plant Autograph and their Revelations এবং Motor Mechanism of Plants বই-এর ছবি।] তারপর বেশ কিছুকাল যন্ত্র-বিজ্ঞান ও টেকনিক্যাল লাইনে শিক্ষাগ্রহণ করতে কেটে গেল। ইতিমধ্যে অবশ্য অবসরমত মাইক্রোস্কোপের কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলাম – কারণ ঐ সব কাজেই উত্সাহ ছিল বেশী।
এরপর একদিন ভিয়েনা থেকে জগদীশচন্দ্রের এক পত্র পাওয়া গেল। [ ১৯২৮ সালে ] আমাকে আলো-দেওয়া উদ্ভিদ সংগ্রহ করে রাখতে বলেছেন। কারণ প্রোফেঃ মলিশ শীঘ্রই কলকাতা যাচ্ছেন এবং তিনি Bio-luminescence সম্পর্কে কাজ করবেন।
কলকাতার আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে আলোবিকিরণকারী উদ্ভিদের সন্ধানে লেগে গেলাম। কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। বেহালার পল্লীঅঞ্চলের দিকে একটা পরিত্যক্ত জায়গায় মাঝে মাঝে এরূপ আলো দেখা গেছে – শুনেছিলাম। রাত্রির অন্ধকারে সেই জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটায় অনুসন্ধান করে কিছুই পাওয়া গেল না – অধিকন্তু চূড়ান্তভাবে নাকাল হয়ে ফিরে আসতে হলো। অবশেষে দেশে যাওয়াই স্থির করলাম। সেখানে এমন কতকগুলি পরিচিত জায়গা ছিল যেখানে আলো-দেওয়া উদ্ভিদ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দেশে গিয়ে দেখলাম – সে সব জায়গা প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সামান্য কিছু সংগ্রহ করা সম্ভব হল বটে, কিন্তু তা প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। ফিরে আসবার দিন এক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। বন্ধুটিও কলকাতায় যাবেন। শেষ রাত্রিতে উঠে স্টেশনে যাব – এই ছিল ব্যবস্থা।
বেশ রাত হয়েছে। দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছি। একটা ডাকাডাকির শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কান পেতে শুনলাম – পশ্চিম দিক থেকে অন্তত দু’জনের গলার শব্দ আসছে। বন্ধুকে ঠেলা দিয়ে জগতে গেলাম। কিন্তু মনে হলো – সে জেগেই আছে অথচ কোন কথায় বলছে না। ডাকাডাকির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে কতকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বললো – ও কিছু নয়। বাড়ির পশ্চিম দিকের ওই লোকবসতিশূন্য জঙ্গলটার মধ্য দিয়ে খালটা এঁকে-বেঁকে চলে গেছে। এই খাল ছাড়া নদীতে পড়বার আর কোন পথ নেই। রাত্রিতেও এই খালে নৌকা চলাচল করে। রাত্রিবেলায় বাঁক ঘুরতে গিয়ে অনেকেই দিক ভুল করে ফেলে। চারদিকে গভীর জঙ্গল,তাতে রাতের অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়ে যায়। তা ছাড়া পাড়াগাঁয়ের লোকের ভূতের ভয়টা খুব বেশী। এই বাঁকের মধ্যে এসে দিকভ্রান্ত নৌকারহীরা প্রায় প্রতিটি রাতেই তাদের রাস্তা বাৎলে দেবার জন্যে ডাকাডাকি করে। এই কারণে প্রায়ই আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। কাজেই সহজে কেউ সাড়া দিতে চায় না আমিও তাই চুপ করেছিলাম। বন্ধুর কথা শেষ না হতেই আবার সেই ডাকাডাকির শব্দ যেন চরমে উঠলো-ও মশাইরা কে আছেন, আমাদের বাঁচান। এমন কাতর কন্ঠে চিত্কার – আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না। বন্ধুটি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ির অন্য ঘরের দু’জনকে দেকে তুললেন আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন – ভয় নেই – আমরা যাচ্ছি। আলো নিয়ে আমরা জঙ্গলের পথে এগুতে লাগলাম – ওরা প্রাণপণে চিত্কার করছে – গেছো ভূত নৌকাশুদ্ধ আমাদের গাছের উপর টেনে তুলছে। কাছে যেতেই দেখা গেল – একটা ধুরি নৌকায় তিনটি লোক পরস্পর জড়াজড়ি করে থর-থর করে কাঁপছে। আমাদের দেখেই একটি লোক নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে কাছে ছুটে এলো এবং বললো – দেখুব কর্তারা, নৌকাটাকে জমিনের উপর কতখানি টেনে তুলেছে। লগির উল্টো খোঁচ মেরে নৌকাটাকে যতবার জলে নামিয়েছি, ততবারই আবার টেনে তুলেছে। ভয় পেয়ে তাড়াহুড়া করে সবাই আমরা মধ্যিখানটায় আসবার সময় ধাক্কা লেগে লন্ঠনের কেরোসিনের বাতিটা উল্টে গিয়ে নিবে যায়। তখনই আমরা ডাকাডাকি শুরু করি। আপনারা না এলে এতক্ষণে আমাদের খতম করে ফেলতো। চেয়ে দেখুন – নৌকাটা এখনও জমিনের উপর জঙ্গলের মধ্যে কতখানি ঢুকে গেছে। আলো নিয়ে কাছে যেতেই দেখা গেল খালের পাড়ের কর্দমাক্ত ঢালু জমির উপর দিয়ে ধুরি নৌকাটা মোতরা গাছের ( যে গাছের ছাল থেকে শীতলপাটি তৈরি হয় ) জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে এবং দু-তিনটা মোতরা গাছের মাথার দিক ধুরি নৌকায় ত্রিশূলের মত গলুইয়ের ফাঁকের মধ্যে ঢুকে গিয়ে গেঁরোগুলির সঙ্গে শক্তভাবে আটকে রয়েছে।
আসল ব্যাপারটা বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না। অন্ধকারে খালের বাঁক ঠিক করতে না পেরে লগি মেরে জোরে খোঁচা দিতেই নৌকাটা সোজাসুজি ঢালু পাড়ের উপর উঠে গিয়ে মোতরা গাছের গেঁরোতে আটকে যায়। লগির উল্টো খোঁচে নৌকাটি পিছনে যাবার সময় গাছগুলি নুয়ে পড়ে, লগি তুলতেই আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় – তার ফলেই নৌকাটা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। যাহোক এত চেঁচামেচি, গণ্ডগোলের সবই এখন একটা হাসির ব্যাপারে পরিণত হলো।
সকলের পেছন পেছন ফিরে আসছিলাম। সামনের লন্ঠনের মিটমিটে আলোটুকু ছাড়া চারদিকে কেবল বড় বড় গাছে ঢাকা গভীর জঙ্গল আর জমাট বাঁধা অন্ধকার। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নি – এবার সেই অন্ধকারের দিকে তাকাতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম। সামনে-পিছনে, ডাইনে-বাঁয়ে – যতদূর চোখ যায়, যেন লক্ষ লক্ষ জোনাকির আলো জ্বলছে। কোন কোন জায়গায় যেন তরল আলোর আস্তরণ বিছানো রয়েছে। যে জিনিসের জন্যে এত দিন ধরে খোঁজাখুঁজি করে আসছি, সেই জিনিসই যে এমন অপ্রত্যাশিতভাবে হাতের কাছে এসে যাবে, এ কখনও কল্পনা করি নি। সবাইকে দেকে দেখালাম এবং প্রচুর পরিমাণে আলো-দেওয়া লতাপাতা সংগ্রহ করে সেই রাতেই কলকাতায় রওনা হলাম। দিন কয়েক পরেই প্রোফেঃ মলিশ এলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করে উদ্ভিদ ও জীবাণুর আলো সম্বন্ধে বেঁক কিছুই জানা সম্ভব হয়েছিল। এরপর বেশ কিছু কাল পর্যন্ত বিভিন্ন ‘মাধ্যমে’ আলো-দেওয়া উদ্ভিদের ছত্রাক-সূত্র ও জীবাণুর ‘কালচার’ এবং মাইক্রোস্কোপের কাজেই ব্যাপৃত ছিলাম। বিশেষ কারণেই অবশেষে কীট-পতঙ্গ সম্পর্কিত গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে হয়।