উভয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রানী ও কর্মী মৌমাছিরা একই রকমের ডিম থেকেই জন্মগ্রহণ করে থাকে। অদ্ভূত হলেও ব্যাপারটা সহজেই উপলব্ধি হতে পারে। স্ত্রী জাতীয় মৌমাছিদের প্রজনন যন্ত্রে যথাযথ পরিপূর্ণতা নির্ভর করে খাদ্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। শ্রমিক মৌমাছিরা স্ত্রী জাতীয় হলেও শৈশবাবস্থা থেকেই তারা প্রতিপালিত হয় ক্ষুদ্রায়তন কুঠুরির মধ্যে। এই সকল কুঠুরিতে মৌমাছির রয়েল জেলী বা দুধ প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ করা হয় না। ঠিক যতটুকু প্রয়োজন কর্মীরা বাচ্চাগুলিকে ঠিক ততটুকু খাদ্যই দিয়ে থাকে। রানীর কুঠুরি অনেক বড়। তাতে বেশী পরিমাণ খাদ্যের স্থান সংকুলান হয়। কাজেই বড় কুঠুরির বাচ্চা শৈশবাস্থায় প্রচুর পরিমাণ সহজ পাচ্য রয়েল জেলী উদরস্থ করতে পারে। প্রচুর খাদ্য উদরস্থ করার ফলে সে যে কেবল আকৃতিতেই অনেক বড় হয় তা নয়, তার দেহ-যন্ত্রাদিও যথাযযথ পরিপুষ্টি লাভ করতে পারে। কিন্তু রানী ও শ্রমিক-মৌমাছির পার্থক্য কেবল প্রজনন যন্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, আকৃতি ও প্রকৃতিগত বহুবিধ পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়। খাদ্যের পরিমাণের তারতম্যে হিসাবে যদি কেবল ক্ষুদ্র ও বৃহদাকৃতির পার্থক্য দেখা যেত তবে ব্যাপারটা সহজবোধ্য হতো সন্দেহ নেই। কিন্তু কর্মীর শরীরের প্রান্তদেশ গোলাকার এবং রানীর শরীরের পশ্চাদ্ভাগ লম্বা ও সূচালো। রানী ও কর্মীর চোয়াল এবং জিভ ভিন্ন ধরনের। রানীর দেহে মোম-উত্পাদক বা রেণু-সংগ্রাহক যন্ত্র নেই, উভয়ের দেহবর্ণেও যথেষ্ট তারতম্য দেখা যায়। তাছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিতে রানী মৌমাছিরা কর্মীদের অপেক্ষা অনেক নিম্নমানের বলে বোধ হয়। রানী জন্মগ্রহণ করবার পর যৌন মিলনের জন্যে একমাত্র বাসা থেকে উড়ে যায়। মিলনের পর চাকে ফিরে সে ডিম পাড়তে আরম্ভ করে। দলের বাসা পরিবর্তন করবার সময় ছাড়া আর কখনও তাকে বাসা ছেড়ে উড়তে দেখা যায় না। কর্মী-মৌমাছিরা তার আহার জোগায়, ডিম পাড়বার স্থান নির্দেশ করে এবং তার যাবতীয় কার্যনির্বাহ করে। মোটের উপর রানীরা কর্মীদের হাতে যন্ত্রের মতো পরিচালিত হয়। তাছাড়া রানীদের এক অদ্ভূত মনোবৃত্তি দেখা যায়। যদি কোনও চাকে কখনও অপর রানী-মৌমাছির আবির্ভাব হয়, তবে উভয়ের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায়। একটি সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও নির্জীব না হওয়া পর্যন্ত্য যুদ্ধের অবসান ঘটে না। কর্মীরা চতুর্দিকে ঘিরে এই যুদ্ধের ফলাফল দেখতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্রই তারা বিজয়ীনিকে তাদের রানীর পদে বরণ করে নেয়। কাজেই রানী ও শ্রমিকের এই যে কতকগুলি গুরুতর পার্থক্য বিদ্যমান, সেটা কি কেবল খাদ্যবস্তুর তারতম্যের উপরেই নির্ভর করে ? অথচ শ্রমিক ও রানী মৌমাছি যে একই রকমের ডিম থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে, তা অতি সহজেই প্রমাণিত হয় ? ডিম ফোটাবার পর দু-তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকের কুঠুরি থেকে বাচ্চা তুলে নিয়ে তাকে যদি রানীর কুঠুরিতে এবং রানীর কুঠুরির বাচ্চা শ্রমিকের কুঠুরিতে রাখা যায় , তবে দেখা যাবে – পরিবর্তন সত্ত্বেও শ্রমিকের কুঠুরি থেকে শ্রমিক এবং রানীর কুঠুরি থেকে রানী-মৌমাছিই উৎপন্ন হয়েছে। এই পরীক্ষা থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, এই জাতীয় ডিম থেকে খাদ্যের তারতম্যানুসারে রানী ও কর্মী মৌমাছি উৎপন্ন হয়। ভিন্ন রকমের একপ্রকার ডিম থেকে পুরুষ-মৌমাছি উৎপন্ন হয়ে থাকে। যৌন-মিলন না হলেও রানী মৌমাছিকে ডিম পাড়তে দেখা যায়।