পুত্তলী অবস্থায় বাচ্চার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আত্মপ্রকাশ করে; অর্থাৎ কতকটা অসম্পূর্ণ থাকলেও এই সময়ে বাচ্চা প্রকৃত মৌমাছির আকৃতি পরিগ্রহণ করে। অবস্থাটা অনেকটা মাতৃগর্ভে অবস্থিত পরিণত মনুষ্যভ্রুণের মতো। আরও কিছুকাল নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করবার পর পূর্ণাঙ্গ মৌমাছির রূপ ধারণ করে কুঠুরির মুখ কেটে বাইরে আসে। নতুন কর্মী জন্মগ্রহণ করবার পর প্রথমত কিছুদিন সে বাসা ছেড়ে মোটেই বাইরে যায় না, বাসার আভ্যন্তরীণ কার্যেই ব্যাপৃত থাকে। আবর্জনা সরিয়ে তারা কুঠুরিগুলিকে পরিষ্কার রাখে, ডানা কপিয়ে কুঠুরির অভ্যন্তরে বিশুদ্ব বায়ু সঞ্চালন করে। চাকের প্রবেশ-পথে পাহারায় মোতায়েন থেকে আক্রমণকারী কীট-পতঙ্গ তাড়াবার ব্যাবস্থা করে এবং কেউ কেউ সংগৃহীত মধু সংরক্ষণের কার্যেও ব্যাপৃত হয়ে থাকে। পক্ষাধিক কাল গৃহকার্যে আত্মনিয়োগ করবার পর মধু সংগ্রহে বহির্গত হয়। মৌমাছিরা সাত-আট সপ্তাহ থেকে প্রায় ছয় মাস কাল জীবিত থাকে, রানী-মৌমাছিকে তিন বছর থেকে প্রায় চার বছর পর্য্যন্ত জীবিত থাকতে দেখা যায়। পুরুষ-মৌমাছিরা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি জন্মগ্রহণ করে যৌন-অভিযানের পর প্রতিকুল অবস্থায় পড়ে নানাভাবে প্রাণত্যাগ করে এবং অবশিষ্ট যারা থাকে তারাও কর্মীদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়।
পূর্বেই বলা হয়েছে – একটি রানী থেকেই হাজার হাজার মৌমাছি জন্মগ্রহণ করে থাকে। পুরুষ, কর্মী ও নতুন রানীরা তারই সন্তান। যৌন-মিলনের ফলে স্ত্রী ও পুরুষ মৌমাছি উত্পন্ন হবার ব্যাপারে কিছুমাত্র নতুনত্ব নেই। জীবজগতে অহরহই এরূপ ব্যাপার ঘটছে। কিন্তু একই রকম বৈশিষ্ট্য সমন্বিত হাজার হাজার কর্মী মৌমাছির উৎপত্তি হয় কিরূপে ? মৌমাছি-জীবনের এটা এক অদ্ভূত রহস্য। গবেষণার ফলে – স্ত্রী, পুরুষ ও কর্মী – এই তিন শ্রেণীর মৌমাছির জন্ম-বৃত্তান্ত সম্বন্ধে যতদুর জানতে পারা গেছে তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
মৌমাছিদের জীবনযাত্রাপ্রণালী পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই একথা মনে হয় যে, রানী মৌমাছি ইচ্ছামত স্ত্রী, পুরুষ, কর্মী মৌমাছি উৎপাদন করতে পারে। ডিম পাড়বার সময় হলেই রানীকে সর্বক্ষণই চাকের উপর ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটি শূন্য কুঠুরিতে এক-একটি করে ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে সকল কুঠুরিতে পুরুষ-মৌমাছি উত্পন্ন হয় সেগুলির আয়তন শ্রমিক মৌমাছিদের কুঠুরি থেকে কিঞ্চিৎ বৃহদাকার। এই উভয় শ্রেণীর কুঠুরি থেকে রানীর কুঠুরীর আকৃতি সম্পূর্ণ পৃথক এবং আয়তনেও তা অনেক বড়। পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেছে – কুঠুরিগুলির আকৃতি বা আয়তনের পার্থক্য সম্বন্ধে কিছুমাত্র বিবেচনা না করেই রানী একাদিক্রমে ডিম পেড়ে যায়। কিন্তু সর্বশেষে দেখা যায় – কুঠুরির আয়তনের তারতাম্যনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীর মৌমাছি জন্মগ্রহণ করেছে ; অর্থাৎ ছোট কুঠুরি থেকে কর্মী, মাঝারি কুঠুরি থেকে পুরুষ এবং বড় কুঠুরি থেকে রানী জন্ম গ্রহণ করেছে। কাজেই পর্যবেক্ষকের পক্ষে এ কথা অনুমান করা স্বাভাবিক যে , রানী ইচ্ছামত কর্মী,পুরুষ ও রানীর ডিম প্রসব করে থাকে। যৌন পার্থক্য হিসাবে প্রকৃত প্রস্তাবে রানী ও কর্মী মৌমাছিদের মধ্যে প্রভেদ অতি সামান্য। রানীদের মতো কর্মী-মৌমাছিরাও স্ত্রী জাতীয়। কিন্তু রানীরা সন্তান-উৎপাদনে সক্ষম পক্ষান্তরে কর্মীরা বন্ধ্যা। রানীদের প্রজনন যন্ত্র যেরূপ পরিপূর্ণতা লাভ করে কর্মী-মৌমাছিদের প্রজনন যন্ত্র সেরূপ পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় না।