মৌমাছিদের কার্যকলাপ দেখে মনে হয় – একটিমাত্র রানীকে অবলম্বন করেই যেন সমাজ বন্ধন গড়ে উঠেছে। কিন্তু রানী বলে তাকে চাকের মৌমাছিদের শাসনকর্ত্রী বুঝায় না। এদের মধ্যে রাজতন্ত্র বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। রানীর কাজ একমাত্র প্রজনন করা। একটি মাত্র রানীই চাকের প্রায় অধিকাংশ মৌমাছির মাতা। রানী কেবল ডিম পেরেই খালাস। একমাত্র যৌন মিলনে অংশ গ্রহণ করা ছাড়া পুরুষ মৌমাছিদেরও আর কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় না। কাজেই মৌমাছিদের কথা বলতে গেলে প্রধানত কর্মী মৌমাছিদেরই বুঝায়। কোনো। কর্মীদের দ্বারাই মৌমাছি সমাজের পরিচয়।
পূর্বে লোকের ধারণা ছিল যে , ফুল থেকে মোম সংগ্রহ করে মৌমাছির তার সাহায্য চাকের কুঠুরিগুলি নির্মাণ করে। কিন্তু অনুসন্ধানের ফলে দেখা গেছে যে, কর্মী মৌমাছিদের পেটের নিম্নভাগে অবস্থিত কতকগুলি গ্রন্থি থেকেই মোম উৎপাদিত হয় এবং সেই মোমের সাহায্যেই এরা চাক নির্মাণ করে থাকে। মৌমাছির ঝাঁক উড়ে যেতে অনেকেই দেখে থাকবেন। উড়তে উড়তে সুবিধামত স্থান দেখতে পেলে সেখানেই কোনও গাছের ডালে বসে পড়ে। বাসা নির্মাণের অনুপযুক্ত মনে করলে দু -একদিন সেখানে অবস্থান করে আবার উড়ে যায়। উপযুক্ত স্থানে উপস্থিত হলে চাক নির্মাণ করবার পূর্বে কর্মী মৌমাছিরা বাসা বাঁধবার জন্য নির্বাচিত স্থানে ঘনসন্নিবিষ্টভাবে ঝুলে কিছুকাল নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করে। এই সময় তাদের উদরের নিম্নদেশে মোম উৎপন্ন হতে থাকে। আমরা সাধারণত যেরূপ মোমের সঙ্গে পরিচিত – প্রথম উৎপন্ন হবার সময় তা মোটেই সেরূপ অবস্থায় থাকে না। মৌমাছির উদরের নিম্নভাগে প্রথম যে মোম উৎপন্ন হয় তা দেখতে অনেকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বচ্ছ অভ্র খণ্ডের মতো। এই স্বচ্ছ মোমের পাতাগুলি মৌমাছির উদরের শক্ত খোলার ভাঁজে ভাঁজে প্রলম্বিত অবস্থায় সজ্জিত থাকে। বাসা নির্মাণ করবার সময় এরূপ অসংখ্য মোমের টুকরা বাসার নিচে ভূমির উপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। মৌমাছিরা এই টুকরাগুলি খুলে নিয়ে চিবিয়ে মুখ-নিঃসৃত অম্লরসাত্মক লালার সঙ্গে মিশ্রিত করে। সেগুলিকে এক প্রকার অস্বচ্ছ বাসা তৈরির মণ্ডে পরিণত করে। এই মণ্ড কাদামাটির মতো প্রয়োগ করে এরা ছয় কোণ-বিশিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুঠুরি নির্মাণ করে। কুঠুরি নির্মাণ শেষ হলে রানী তার শরীরের পশ্চাদ্ভাগ কুঠুরির ভিতরে প্রবেশ করিয়ে প্রত্যেকটিতে এক-একটি করে ডিম পেড়ে যায়। ডিম ফুটে কীড়া বের হবার পর কর্মীরা তাদের শরীর থেকে উৎপন্ন এক প্রকার সাদা ঘন তরল পদার্থের সঙ্গে ফুলের রেণু প্রভৃতি মিশিয়ে তাদের খেতে দেয়। এই পদার্থকে ‘রয়েল জেলী’ বা মৌমাছির দুধ বলা হয়। কুঠুরির পার্থক্য অনুযায়ী অর্থাৎ বাচ্চাগুলির ভবিষ্যৎ পরিণতির উপর লক্ষ্য রেখেই বোধ হয় খাদ্যের পরিমাণের তারতম্য করা হয়ে থাকে। বাচ্চাগুলির শৈশবাবস্থা অতিক্রম করবার পর মোমের সাহায্যে কর্মীরা তখন কুঠুরির মুখ বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই বাচ্চাগুলির কৈশোর অবস্থা চলতে থাকে। কুঠুরির মুখ বন্ধ হবার পরেই বাচ্চা তার মুখে সূক্ষ্ম সুতা বের করে দেহের চতুর্দিকে একটি যুগ্ম আবরণী গড়ে তোলে। এই আবরণীর মধ্যে নিশ্চেষ্টভাবে অবস্হান করে কীড়া পুত্তলীতে রূপান্তরিত হয়। কীড়া অবস্থায় তাদের হাত-পা বা অন্য কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিহ্নমাত্র থাকে না।