মৌমাছির জীবন-রহস্য
প্রয়োজনের তাগিদে কেবলমাত্র বন্য পশুপক্ষীকে বশীভূত করেই মানুষ ক্ষান্ত থাকেনি, বিভিন্ন জাতীয় কিট-পতঙ্গকেও পোষ মানিয়ে তাদের দ্বারা প্রয়োজনীয় কার্যোদ্ধার করিয়ে নিচ্ছে। মৌমাছি এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মধু আহরণ করবার নিমিত্ত কোন সময়ে মানুষ প্রথম মৌমাছি পালন শুরু করেছিল, তা সঠিক নির্ণয় করতে না পারলেও সেটা যে সহস্রাধিক বছর পূর্বের কথা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে বর্তমান যুগে যেরূপ উন্নত কার্যকর পন্থায় মৌমাছি পালন করা হয়, প্রাচীন প্রথা যে তার চেয়ে বহুলাংশে নিকৃষ্ট ছিল, তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। মোটের উপর তখন মধু আহরণের নিমিত্ত সুবিধামত স্থানে চাক নির্মাণে মৌমাছিগুলোকে প্রলুব্ধ করবার জন্যেই বিবিধ কৌশল অবলম্বিত হতো। আজও পল্লী অঞ্চলে মৌমাছির ঝাঁক উড়ে যাবার সময় সেগুলিকে চাক বাঁধতে প্রলুব্ধ করবার জন্যে কয়েক প্রকার অদ্ভূত প্রথার প্রচলন দেখা যায়। যাহোক, মৌমাছি পালন সম্বন্ধে আলোচনা বর্তমান প্রসঙ্গের উদ্দেশ্য নয়। এস্থলে সাধারণ-ভাবে তাদের জীবনযাত্রা-প্রণালীর বিষয় কিঞ্চিত আলোচনা করবো।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা জাতীয় মৌমাছি দেখা যায়। আমাদের দেশেও বিভিন্ন জাতীয় কয়েক রকমের মৌমাছি দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে ; এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বৃহদাকারের বুনো বা বাঘা মৌমাছিই সবচেয়ে উগ্র প্রকৃতির এবং অধিকতর মধু-সঞ্চয়ী। উঁচু গাছের ডালে, বড় বড় গাছের ফাটলে, দালানের কার্নিশে অথবা ছায়াছন্ন কোন গাছের ডালে মৌমাছিরা বড় বড় চাক নির্মাণ করে বসবাস করে। এক-একটা চাকে একটা ৩০/৪০ হাজার থেকে ০৭/৮০ হাজার মৌমাছি দেখা যায়। পরস্পর গাত্র সংলগ্ন হয়ে এক-একটি চাকে এত অধিক সংখ্যক মৌমাছি বাস করলেও তাদের পরস্পরের সঙ্গে কখনও ঝগড়াঝাঁটি ঘটতে দেখা যায় না। অবশ্য সময়ে সময়ে এক চাকের মৌমাছি অন্য চাকের মৌমাছিগুলিকে আক্রমণ করে লুঠতরাজ করবার চেষ্টা করে থাকে। এরা ব্যক্তিগত সুখসুবিধার বিষয় উপেক্ষা করে সমাজের মঙ্গলের জন্যই দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমে কাজ করে থাকে এবং প্রয়োজন হলে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কিছুমাত্র ইতস্তত করে না। যাঁদের একটু বিশেষভাবে মৌচাক লক্ষ করবার সুবিধা হয়েছে , তাঁরা জানেন যে ; কিরূপ বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে মৌমাছিগুলি তাদের দৈনন্দিনকর্ম নির্বাহ করে থাকে। সারা শীতকালটা এরা সঞ্চিত মধুর উপর নির্ভর করে অনেকটা নিশ্চেষ্টভাবে কাটাবার পর বসন্তের আবির্ভাব থেকে যেভাবে মধু আহরণ, চাক নির্মাণ, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসার আবর্জনা পরিষ্কার এবং শত্রুপ্রতিরোধ প্রভৃতি বিভিন্ন কার্যে ব্যাপৃত থাকে, তা দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এই রকমের বিভিন্ন কাজের জন্যে এদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ দেখা যায়। যার যা কাজ, সে যেন তা যন্ত্রের মতোই করে যাচ্ছে। এতে তাদের কণামাত্র ক্লান্তি বা অবসাদ নেই। কোনো কারণে অক্ষম বা দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত এই কর্ম-প্রচেষ্টার বিরাম ঘটতে দেখা যায় না।