পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণীর মধ্যেই নির্বিঘ্নে বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করবার জন্যে এবং সেই সময়ে আত্মরক্ষার নিমিত্ত বিবিধ প্রকারে সুরক্ষিত বাসস্থান নির্মাণ করে তাতে আত্মগোপন করবার একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দেখা যায়। যে সকল প্রাণী বাসস্থান নির্মাণ করে না, তারাও নির্বিঘ্নে বিশ্রাম উপভোগ করবার জন্যে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে থাকে। আমাদের আশেপাশে অহরহ যে সকল প্রজাপতি দেখতে পাই, তারা কেউ বাসা বাঁধে না; কিন্তু নিরুপদ্রবে অবসর কাল কাটাবার জান্যে আত্মগোপনোপোযোগি বিশ্রামস্থল বেছে নেয়। এর ফলে অপেক্ষাকৃত অনাবৃত স্থানে থেকে এরা মানুষ বা অন্যান্য শত্রুর দৃষ্টি এড়াতে সক্ষম হয়। এস্থলে আমাদের দেশের কয়েক প্রকার সাধারণ প্রজাপতির বিশ্রামকালীন আত্মগোপন কৌশলের বিষয়ে আলোচনা করছি।
আমাদের দেশে সচরাচর এক প্রকার সাদা প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায়। এদের ডানা প্রসারিত করলে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পাশাপাশিভাবে দুই ইঞ্চিরও কিছু বেশী লম্বা হয়। ডানার উপরিভাগ দুধের মতো সাদা; কিন্তু উভয় ডানার সংযোগস্থল থেকে কতকটা অংশ ঈষৎ হলদে। ডানার নিম্নভাগ নীলাভ ফিকে সবুজ। লড়বার সময় সাদা দিকটাই স্পষ্টগোচর হয়। উড়তে উড়তে কখনও অল্প সময়ের জন্য বিশ্রামের প্রয়োজন হলে এরা সাধারাণত যমজপত্রসমন্বিত গাছের পাতার উপর আধাআধি ডানা মেলে বসে।পাতার রঙের সঙ্গে এদের গায়ের রং ও আকৃতি এমনভাবে মিলে যায় যে, অতি নিকটে থেকেও তাদের গাছের পাতা বলে ভুল হয়। কিন্তু ভয় পেলে অথবা রাত্রিবাস করবার সময় উড়ে গিয়ে গাছের উঁচু ডালের পাতার উপর ডানা মুড়ে বসে। তখন পাতার রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিলে থাকে যে, খুঁজে বের করা যায় না।
ডানার একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পাশাপাশিভাবে প্রায় তিন ইঞ্চি সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা ফিকে হলদে রঙের এক প্রকার প্রজাপতিকে সর্বদাই ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। এদের ডানার উপর ও নিচে বড় বড় কতকগুলি কালো ফোঁটা আছে। ডানার এই বর্ণবৈচিত্র্যে বহুদূর থেকে এদের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বিশ্রাম করার সময় এরা পত্রবিরল লতার ঝোপের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। ডানা গুটিয়ে এই জাতীয় লতার মধ্যে অবস্থান কালে লতার আঁকাবাঁকা ডাঁটাগুলির সঙ্গে মিলে গিয়ে প্রজাপতির গায়ের রেখাগুলি এমন একটা দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করে যে, তার মধ্যে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা থাকা সত্ত্বেও প্রজাপতি লুকিয়ে আছে বলে বুঝতে পারা যায় না।
এদেশে বনে-জঙ্গলে ‘লৌ-ফোঁট’ বা রক্ত-তিলক নামে ঘোর কাল রঙের একপ্রকার বড় বড় প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রজাপতির নিম্ন ডানার প্রান্তভাগে অর্ধচন্দ্রাকার কতকগুলি রক্ত বর্ণের ফোঁটা সারবন্দিভাবে অঙ্কিত থাকে, নিম্নভাগের ডানার মধ্যস্থলে পাশাপাশিভাবে কয়েকটি সাদা দাগ আছে। দিনের বেলায় ক্ষণিক বিশ্রাম করবার সময় এবং রাত্রিকালে এই প্রজাপতিরা অন্ধকার ঝোপের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ঝোপের মধ্যে গাঢ় সবুজ রঙের পাতার উপর রাতটা বসে কাটায়। সাধারণত প্রজাপতির ডানার নিম্নভাগের রং ফিকে এবং নিস্প্রভ হয়ে থাকে এবং বসবার সময় ডানা ভাজঁ করে রাখে; কাজেই সহসা কারও দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু এই রক্ত তিলক প্রজাপতির ডানার নিচের দিক উপরের দিক অপেক্ষা উজ্বলতর। যে কারণেই হোক, এরা ডানা ভাজঁ করে বসেনা; মথদের মতো এরা ডানা মেলে বিশ্রাম করে। কাজেই পৃষ্ঠদেশের অনুজ্জ্বল অংশই বাইরের দিকে থাকে। অন্ধকার স্থানে গাঢ় রঙের পাতার উপর বিশ্রাম করবার ফলে এরা অনায়াসে শত্রুর চোখে ধুলি নিক্ষেপ করতে পারে।