এ ঘটনার অনেক দিন পরে মালদহ জেলার একটি গ্রামের ভিতর দিয়ে যাবার সময় একটা গাছের পাতার গায়ে আমড়ার আঁটির মতো একটা গুটি দেখতে পেয়ে সেটাকে একটা বোতলে ভরে রেখেছিলাম। সকালে উঠে দেখি, ডানায় বিচিত্র ডোরাকাটা প্রকাণ্ড একটা প্রজাপতি বোতলটার মধ্যে ঝটপট করছে। আমরা সাধারণত যেরূপ প্রজাপতি দেখতে পাই, এর চেহারা মোটেই সেরূপ নয়। ডানাগুলি অপেক্ষাকৃত মোটা ও ভারী। ডানার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা। বোতলের অপ্রশস্ত স্থানের মধ্যে ডানা দুটি মুড়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। আকৃতি বড়ই হোক কী ছোটই হোক, তাতে বিস্মিত হবার তেমন কিছু নেই; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, কেমন করে একটা শোঁয়াপোকা বা গুটি থেকে বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি বেরিয়ে আসে ?
কলকাতার সন্নিহিত কোনও এক পল্লী অঞ্চলে দুপুর বেলায় এক স্থানে বসে ছিপে মাছ ধরা দেখছি। প্রায় দু’শ গজ দূরে ঝোপের মধ্যে একটা উজ্জ্বল পদার্থের প্রতি দৃষ্টি আকৃস্ট হলো। নিকটে গিয়ে দেখি, ছোট্ট একটা নীলকণ্ঠ ফুলের গাছের পাতার নিচের দিক থেকে একটা অদ্ভুত পদার্থ ঝুলে রয়েছে। জিনিসটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা, দেখতে কতকটা চীনাবাদামের মতো; কিন্তু বর্ণ উজ্জ্বল নীল। পড়ন্ত সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সেটা একটা বেলোয়ারি কাচের দুলের মতো ঝিকমিক করছিল। এর গঠন-পারিপাট্য ও রঙের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। জিনিসটা কি বুঝতে না পেরেও কেবল সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েই সেটাকে এনে একটা শিশিতে পুরে রাখলাম। দুই দিন একই ভাবে ছিল। তৃতীয় দিন ভোরে উঠে দেখলাম – সে অপূর্ব বস্তুটার খোলস পড়ে রয়েছে, কিন্তু তার সেই ঔজ্জ্বল্য নেই। পাশেই বিচিত্র বর্ণের একটা প্রজাপতি বাইরে আসবার জন্যে ছটফট করছে।
পর পর এই কয়টি ঘটনা থেকে প্রজাপতির জন্মের একটা মোটামুটি আভাস পেলাম বটে, কিন্তু জন্মের ধারাবাহিক ইতিহাস সম্বন্ধে কিছুই অনুমান করতে পারলাম না। এই ঘটনার কিছুদিন পরে শিবপুরের কোনও একটি বাড়ির রান্নাঘরের অন্ধকারাচ্ছান্ন দেয়ালের গায়ে প্রায় নয় ইঞ্চি লম্বা একটা অদ্ভুত প্রজাপতি দেখতে পেলাম। দুই দিকের ডানার উপর পেঁচার চোখের মতো গোলাকার উজ্জ্বল নীলবর্ণের দুটি ছাপ, হঠাৎ মনে হয় যেন অন্ধকারের মধ্যে একটা পেঁচা তার গোলাকার চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে। অনেক কৌশলে সেটাকে জীবিত অবস্থায় ধরতে পেরেছিলাম। একটা জালের খাঁচায় সেটাকে রেখে দিলাম। কী খায় জানি না; কাজেই খাবার কিছু দেওয়া সম্ভব হয় নি। দুই দিন পর্যন্ত প্রজাপতিটাকে জালের উপর একভাবে ডানা মেলে বসে থাকতেই দেখলাম। তৃতীয় দিনে দেখা গেল জালের গায়ে পাশাপাশি ভাবে অসংখ্য ডিম পেড়ে রেখেছে। ডিম পাড়বার দুই দিন পরে প্রজাপতিটা মরে গেল। ডিমগুলিকে সেভাবে রেখে দিলাম। প্রায় মাস দেড়েক পরে সেই ডিম ফুটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য শোঁয়াপোকা বেরিয়ে এলো। তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, শোঁয়াপোকারা প্রজাপতিরই বাচ্চা। এখন কী উপায়ে শোঁয়াপোকা প্রজাপতির রূপ ধারণ করে – সেটাই অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠলো।