এর আগে আমরা দেখেছিলাম কিভাবে মূর্তি বিসর্জন বা ক্রমাগত আবর্জনা ফেলার ফলে গঙ্গা নদী তার স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলছে। এই দূষণ যে কি মারাত্মক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, সেটা গবেষকদের কল্যাণে আমরা জানতে পারছি। আর শিউরে উঠছি এই ভেবে যে, প্রকৃতির দেওয়া সেই স্বচ্ছ, পবিত্র নদীটিকে আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে কি? নিজেই দেখুন লেখার এই দ্বিতীয় অংশটিতে।
দূষিত জলে ব্যাকটেরিয়ার জিন পরিবর্তন
কলুষিত হতে হতে গঙ্গার জল এখন এমন অবস্থায় চলে এসেছে যে তার মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন এক প্রজাতির জিন। যা বিভিন্ন জলজ ব্যাক্টেরিয়ার জীবনচক্রে মিশে গিয়ে সেগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে তুলছে বলে দাবি করলেন এক দল গবেষক। ব্রিটেনের নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লি আইআইটি-র বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান পত্রিকা ‘জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি’তে। গবেষকদের দাবি: গঙ্গার উজানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জলের নমুনা সংগ্রহ করে তাঁরা জিনটি খুঁজে পেয়েছেন। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে সব ব্যাক্টেরিয়ার জীবনচক্রে সেটি প্রবেশ করে, অ্যান্টিবায়োটিক তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারে না।
এখানেই শেষ নয়। অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়াগুলো এক বার মানুষের শরীরে ঢুকলে স্থায়ী ভাবে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে। অন্ত্রে বাসা বেঁধে বংশবিস্তার করে। এবং মলবাহিত হয়ে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে, সেখান থেকে আরও মানুষের দেহে। তারা জিন সঞ্চারিত করে অন্য অপ্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াকেও অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে তোলে। যে প্রক্রিয়া জারি থাকলে গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর গবেষকদের অনেকে।
জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি’তে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক নিউ ক্যাসলের ডেভিড গ্রাহাম জানাচ্ছেন, গত বছর মে-জুনে তাঁরা হৃষিকেশ-হরিদ্বারে গঙ্গার জলের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। নমুনাগুলি পরীক্ষা করা হয় দিল্লি আইআইটি-র ল্যাবে। প্রতিটি নমুনাতেই হদিস মিলেছে বিশেষ জিনটির, গবেষকেরা যার নাম দিয়েছেন BLANDM-1। এর অস্তিত্ব প্রথম মালুম হয়েছিল ২০০৮-এ, দিল্লির যমুনাজলে। তার পরেই দিল্লি আইআইটি সবিস্তার গবেষণায় নামে। উদ্যোগের অংশীদার হয় নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়।
ওদের যৌথ গবেষণার রিপোর্ট বলছে, মে-জুনে হৃষিকেশ-হরিদ্বারে পর্যটকের সংখ্যা বাড়লে গঙ্গার জলে BLANDM-1 জিনেরও পোয়াবারো হয়। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় মে-জুনে তাদের সংখ্যা বাড়ে প্রায় ৬০ গুণ। বিজ্ঞানীদের অভিমত, জলে বর্জ্য মেশার ফলেই জিনটির জন্ম। কলিফর্ম-সহ গঙ্গার জলে বসবাসকারী যাবতীয় ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যেই তাঁরা এটির উপস্থিতি ধরতে পেরেছেন। যে কারণে গঙ্গাপাড়ের বাসিন্দাদের সতর্ক করেছেন।
গবেষকেরা জানান, কুম্ভ ইত্যাদি নানা তীর্থযাত্রাও গঙ্গার জলে BLANDM-1 জিনের পরিমাণ বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। “আমরা দেখেছি, বিভিন্ন তীর্থের সময়ে গঙ্গায় ওই জিনের উপস্থিতি অন্তত ২০ গুণ বাড়ে। কুম্ভমেলা দশেরা ছটৃ বা অন্য পরবের সময় লক্ষ তীর্থযাত্রীর মলমূত্র যেমন গঙ্গায় মেশে, তেমন সিঁদুর, তুলসীপাতা, ফুল-বেলপাতার মতো বর্জ্যও জলে মেশে। আমাদের অনুমান, এ হেন পরিস্থিতিতে জিনটির বংশবৃদ্ধি দ্রুত হয়।” লিখেছেন গ্রাহাম।
নাইসেডের বিজ্ঞানী প্রভাসচন্দ্র সাধুখাঁর কথায়, “এটা এক ধরনের অভিযোজন। অনুকূল পরিবেশে বাঁচার তাগিদে নতুন জিনের জন্ম।” এবং হরিদ্বার বা হৃষিকেশের গঙ্গায় যখন এর সন্ধান মিলেছে, তখন কলকাতার গঙ্গাতেও তা পাওয়া যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয় বলে প্রভাসবাবুর আশঙ্কা। এই কথা মাথায় রেখে তাঁর সুপারিশ: গঙ্গার জলে বর্জ্য ফেলা অবিলম্বে বন্ধ করা জরুরি। নচেৎ জনস্বাস্থ্যে গুরুতর সঙ্কট দেখা দেবে। এ সম্পর্কে গঙ্গাপাড়ের অধিবাসীদের সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শও দেন তিনি। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ-বিজ্ঞানী শরদিন্দু চক্রবর্তীর আক্ষেপ, “গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে বর্জ্য ফেলা বন্ধের প্রস্তাব ছিল। তার পিছনে তিন দফায় বেশ কয়েকশো কোটি টাকা খরচও করেছে কেন্দ্র। তবু গঙ্গার জল দূষিত হচ্ছেই।” মানুষকে সচেতন করা না গেলে গঙ্গার দূষণ-সমস্যা যে মেটার নয়, গবেষণাপত্রটি তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বলে মনে করছেন ওই পরিবেশ-বিজ্ঞানী।
নদীপারের ট্যানারি
কানপুরের সবচেয়ে বড় চামড়া কারখানা সুপার ট্যানারি লিমিটেডের পরিচালক ইমরান সিদ্দিকী বলেন, নদীদূষণের জন্য শুধু ট্যানারি কারখানাকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এ খাতটি যে লাভজনক, তা কেউ দেখছে না। তিনি বলেন, এখানে একটি সত্য আছে, তা হলো নদীদূষণের মোট বর্জ্যের মাত্র ২ শতাংশে জন্য দায়ী ট্যানারিগুলো।
কিন্তু রসায়নবিদ অজয় কানুজিয়া বলেন, ট্যানারিগুলোতে প্রতিদিন কী পরিমাণ বিষাক্ত তরল সৃষ্টি হয় এটা কেউ জানে না। তবে সবার ধারণা, প্রতিদিন ৯০ লাখ লিটার। কানপুরের ৪০০র অধিক ট্যানারী থেকে মেশা ক্রোমিয়াম বিষ এর গাঢ়ত্ব বিপদসীমার ৭০ গুন। সকল নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক একমত যে রাসায়নিক বা শিল্পদূষণের অর্ধেকের বেশি আসে চামড়া কারখানা থেকে। গঙ্গায় মেশা বর্জ্য তরলের ১২ শতাংশ বিবিধ শিল্পের উপজাত(industrial effluents), যেমন কাগজশিল্প, চর্ম শিল্প, বস্ত্রশিল্প, কসাইখানা, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ, পাতনশিল্প ইত্যাদি।
গঙ্গাজল না নর্দমার জল
শ্রীরাম ইন্সস্টিটিউট ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ২,৫২৫ কিমি প্রবাহ পথে ভারতের প্রায় ৪০ শতাংশ জনবসতি। প্রতি বছর কোটি কোটি কোটি লিটার নর্দমার জল সরাসরি গঙ্গায় এসে পড়ে। এর ফলে জলে দূষণের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে । জলে জীবাণু, বিশেষ করে.ই-কোলাইয়ের মতো মারাত্মক ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং গঙ্গার জল বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। গঙ্গা এখন কার্যত কলেরা, কৃমি, টাইফয়েড, ভাইরাল ফিভার, কানে সংক্রমণ, গ্যাস্ট্রোয়েনটারাইটিস এবং হেপাটাইটিস-এ,বি,সি,ই, ডিসেন্ট্রি প্রভৃতি রোগের আঁতুড় ঘর হয়ে উঠেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে:
গঙ্গোত্রী | পানের অযোগ্য |
দেব প্রয়াগ | চাষে ব্যবহারের অনুপযুক্ত (fecal colliform>5000mpn/dl) |
কানপুর | জলে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণের আতঙ্কজনক বাড়বাড়ন্ত |
ঋষিকেশ | চাষে ব্যবহারের অনুপযুক্ত |
হরিদ্বার | চাষে ব্যবহারের অনুপযুক্ত |
এলাহাবাদ | ই-কোলাইয়ের ভাঁড়ার |
খোদ উৎস থেকেই দূষণ শুরু
গতবছরের গবেষণা অনুযায়ী স্টার আনন্দ জানিয়েছিল যে, গঙ্গোত্রী থেকেই দূষিত হতে শুরু করেছে গঙ্গা। হিন্দুদের এই পবিত্র তীর্থক্ষেত্র গঙ্গার উৎসস্থল গোমূখ থেকে মাত্র ২০ কিমি দূরে।
গঙ্গার জলে সংক্রমণের সূচক হলো ব্যাকটেরিয়ার সম্ভাব্য সর্বাধিক সংখ্যা (mpn=maximum probable number) । গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই সংখ্যাটি বেশ ভয়াবহ। গঙ্গোত্রীতে এর পরিমাণ ২৬ প্রতি ১০০mL , দেব প্রয়াগে ২২,০০০, হরিদ্বারে ১৪,০০০, কানপুরে ৩,৫০০,০০, এলাহাবাদে ৭০,০০০, বারাণসীতে ৮৮,০০০, পাটনায় ৪৬,০০০ এবং মালদায় ৯০০। সাধারণভাবে mpn পরিমাণ প্রতি ১০০mL এ ১০ ছাড়ালেই তা বিপজ্জনক। ব্যাকটেরিয়ার এরকম উপস্থিতি থেকে স্পষ্ট যে, গঙ্গার জল পান তো দূরের কথা তা চাষবাস এবং স্নানেরও উপযুক্ত নয়।
গঙ্গা রক্ষার জন্য শহীদ
গঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখার দাবিতে হরিদ্বারের স্বামী নিগমানন্দ ১১৪ দিন অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন ২০১১তে। তিনি তো রাজনীতির কোন দলের কেউ ছিলেন না, শিল্পপতিও ছিলেন না। চার মাস ধরে তার অনশনশেষে মৃত্যুতে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার বা উত্তরখণ্ডে বিজেপি সরকার,কারো মাথাব্যথা হয় নি। মাথা ধরে নি মুখরোচক সংবাদে দেশ উত্তাল করা সংবাদমাধ্যমগুলোরও। শুধু পরিবেশকর্মী জয়া মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী বা নদীবিশেষজ্ঞ কল্যান রু্দ্রের ক্ষীণ কন্ঠের আক্ষেপ শোনা গেছিল।
গঙ্গাবক্ষের পাথর তোলা আর পাথর ভাঙ্গার ক্রাশারের কারবারে সিলিকোসিসের মত দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলেন এলাকার গরিব মানুষ। ভোটদরদী সরকার জনদরদী স্বামী নিগমানন্দকে নিরবে মরতে দিলেন।
গঙ্গাদূষণের ভয়াবহ পরিণাম
পরমার্থ নিকেতনের স্বামী চিদানন্দ সরস্বতী বলেছেন, গঙ্গা দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গঙ্গার তীরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে নদী দূষণের কারণে প্রতিবছর ১০ লাখ মানুষ মারা যায় এবং এ বিষয়টি বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারে না। বোমা বিস্ফোরণে ১০জন আহত হলে গোটা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়, অথচ এক্ষেত্রে কারো কোন হেলদোল নেই।
গঙ্গাদূষণ শুধুমাত্র গঙ্গাতীরে বসবাসকারী ৪০ কোটি ভারতীয়েরই ক্ষতি করছে না, করছে ১৪০টি মাছের প্রজাতি, ৯০টি উভচর প্রাণীর প্রজাতি ও ভারতের জাতীয় জলচর প্রাণী গাঙ্গেয় শুশুকেরও।
২০১২তে Indian council of medical research এর উদ্যোগে national cancer registry programme এর সমীক্ষায় দেখা যায় দেশের ৩০টি রাজ্যের মধ্যে গঙ্গাতীরবর্তী উত্তর্ প্রদেশ, বিহার বা পশ্চিমবঙ্গে ক্যানসারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সরকারী হাসপাতালের রেকর্ডই বলছে ভারতে শিশুমৃত্যুর জন্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী গঙ্গাজলবাহিত সংক্রমণ।
গঙ্গা অ্যাকসন প্ল্যান
১৯৮৬ সালে বারানসীর ঘাট থেকে শূরু হয়েছে ‘গঙ্গা অ্যাকসন প্ল্যান’ এর বহু শত কোটি টাকার যাত্রা। জনতা ও সেচ্ছাসেবী বেসরকারী সমীক্ষক সংস্থার মতে এর নীট ফল শূন্য। ভারতের সনাতন নগরী, প্রাচীনতম তীর্থ, বর্তমান(2014) প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনীক্ষেত্র, সেই বারানসীতে গঙ্গাদূষণের মাত্রা ১-২ million mpn/ml।
সংকটমোচন ফাউনণ্ডেশন নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় প্রকাশঃ
Location / Parameters | Biochemical Oxygen Demand (mg/l) | Fecal Coliform Count / 100ml |
At beginning of the Varanasi City … Near Assi/Tulsi ghat | 3-8 mg/l | 20,000 – 100,000 per 100ml |
Downstream of the Varanasi City … Varuna confluence with Ganga | 20-50 mg/l | 100,000,000-200,000,000 per 100ml |
Permissible limits for bathing | Less than 3mg/l | Less than 500 per 100ml |
পুণ্যস্নান কি পাপস্নানে রূপান্তরীত? পাঁচ-দশ হাজার বছর আগে গঙ্গা সত্যই প্রাণদায়ী কলুষনাশিনী ছিল। এতদিনকার অজস্র পাপের ভারে জর্জরিত গঙ্গা আজ মৃতপ্রায়। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। অথচ গঙ্গার পার বাঁধানো ও গঙ্গাপারের সৌন্দর্য্যায়নের অন্যান্য ব্যবস্থা যা গঙ্গা পরিকল্পনার নামে কলকাতায় বা বারানসীতে নেওয়া হয়েছিল গত তিরিশ বছরে তা অত্যন্ত হাস্যকর। মূমুর্ষু দেহে অলঙ্কার পরিয়ে সেবা করার মতই নিষ্ঠুর অপব্যয়।
দূষণ বাড়ানোর উদ্যোগ চলছে …
সম্প্রতি গঙ্গাকে বাণিজ্যিক যাতায়াতের জলপথে রূপান্তরীত করা ও বারানসী থেকে হূগলী পর্যন্ত ১৬০০ কিমি পথে গঙ্গা ও তার উপনদীর উপর ১৬টি বাঁধ নির্মাণ করার কথা বলা হচ্ছে সরকারপক্ষ থেকে। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানীচালিত নৌ চলাচলে নদীর দূষণ বাড়বে এবং ১৬টি বাঁধ নদীস্রোত রুদ্ধ করে ১৬টি বড় পুকুর তৈরী করবে। এই উদ্যোগ গঙ্গার স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা পুনরুদ্ধারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী।
… যা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত
গঙ্গার উচ্চপ্রবাহে রয়েছে অলকানন্দা নদীতন্ত্র। সম্প্রতি বিশেষ্জ্ঞদের পরামর্শের উপরে নির্নীয়মান ২৪টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ত্যাগ করতে হবে গঙ্গা ও তার দুই তীরের জীবজগৎ বাঁচাতে। ভারতের বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞরাই এটা চেয়েছেন। নেপালের নদীগুলি যেমন মহাকালী, কর্ণালী, গণ্ডক, কোশী, গঙ্গানদীর মোট জলের ৪০ শতাংশ এবং শুখা মরশুমে গঙ্গার জলের ৭০ শতাংশ দেয়। এদের উপরে যত বাঁধ নির্মিত হয় গঙ্গার জলের বেগ ও পরিমাণ তত কমে। কিন্তু প্রধানত ভারত সরকারের পরিচালনায় ভারত-নেপাল যৌথ উদ্যোগে বাঁধগুলি করা হচ্ছে ও হবে।
উন্নয়নের নামে করা এইসব প্রকল্প কিন্তু ৪০-৫০ কোটি ভারতীয় (সাথে আরো আনুমানিক সাত কোটি বাংলাদেশি ও নেপালবাসীর) জীবনরেখা উদ্ধারের নীতির পরিপন্থী। South Asia Network on Dams, Rivers and People জানাচ্ছে Indian Himalayas moving towards highest Dam Densities in the World। নির্মানরত ও নির্মানের উদ্যোগ হয়েছে এমন বাঁধের সংখ্যা প্রায় ৪০০। Ganga basin would have the highest number of dams (1/18 km of river channel dammed) in the world, followed by the Brahmaputra (1/35 km) and the Indus (1/36 km)।
মূর্তি বিসর্জন ইত্যাদির বিকল্প উপায়
নিত্যপূজার উপচার বাসী ফুল, ফল, পাতা, ছাই, ধূপকাঠির শেষাংশ নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে, বদলে মাটিতে পুঁতে দেওয়া যেতে পারে। ঔপচারিক পূজার বদলে নামজপ, গায়ত্রী জপ, সূর্যপ্রণাম, আসন, মনঃসংযোগ, ধ্যান, প্রানায়াম বা ব্যাবহারিক কর্মের নিষ্কাম যোগে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্বর্গপুরুষার্থ ও কর্মযোগের আদর্শ সকল যুগের উপযোগী।
দুর্গাপূজা ইত্যাদি সম্মিলিত পূজা এবং সমবেত যাগযজ্ঞের শেযে বর্জ্য উপচার এবং মূর্তি নদী বা পুকুরে না ফেলে জৈব ও অজৈব রাসায়নিক উপাদানগুলির প্রতিটির নিজ নিজ পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে শাস্ত্রীয় নিষেধ নেই, কেবল আচারে অনুমোদন দিতে হবে সকলকে, প্রয়োজনে আইন প্রনয়ন করতে হবে।
মিউনিসিপ্যালিটি ও পঞ্চায়েতগুলিকে নিশ্চিত করতে হবে যে পয়ঃপ্রনালীর জল নদীতে না যায়। মানুষ ও গৃহপালিত পশুর মৃতদেহ যেন নদীতে ফেলা না হয়। পশুর মৃতদেহ কবর দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।
জলপ্রবাহ বাড়ানো যায় কিভাবে
মোট জলপ্রবাহ ও স্রোতের বেগ বাড়াতে নদীর বুকের বাঁধগুলি তুলে দিতে হবে। নদীতে বাঁধ দিলে নদীর অপমৃত্যু হয়। নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বর্তমানে ৩৪ টি নদীবাঁধ সরিয়ে দেবার সুপারিশ করেছেন। মোটজলপ্রবাহ বেশি থাকলে আগত বিষ দ্রুত লঘু হয়ে যায়, স্রোতের বেগ বেশি থাকলে বিষ দ্রুত দূরে অপসারিত হয়।
গঙ্গার উৎস থেকে প্রবাহ বরাবর সর্বত্র গঙ্গায় নোংরা জল ফেলা বন্ধ না করলে এবং গঙ্গার কোন নদী-উপনদীতে নতুন করে বাঁধ দিয়ে গঙ্গার জলপ্রবাহ কমিয়ে দেওয়া বন্ধ না করলে, নদীতে মৃতদেহ ফেলা বন্ধ না করলে, শহরগুলিতে গঙ্গার দুইপারে কঠিন আবর্জনা জমানো বন্ধ না করলে, কলকারখানা ও শহরের পয়ঃপ্রনালীর শেষ-মুখ শোধনাগারে না গেলে এবং সারা দেশে বারো মাসে তের পার্বনের অজস্র (কয়েক কোটি) মুর্ত্তি নিমজ্জন বন্ধ না করলে, গঙ্গায় প্রাতঃকৃত্য বন্ধ না করলে কিছুতেই কোন এলাকায় গঙ্গাদূষণ কমানো যাবে না। ছোট ছোট এলাকাভিত্তিক চেষ্টা কোন সুফল দেয় নি, দেবে না।
সুপ্রীম কোর্ট বলতে বাধ্য হয়েছেন, ২০০ বছরেও গঙ্গাশোধন হবে না। আমরা মঙ্গল গ্রহে যেতে সফল, কিন্তু গঙ্গাদূষণনিয়ন্ত্রণে? যা ৫০ কোটি ভারতীয়ের জীবনরেখা? গঙ্গাদূষণ নিয়ন্ত্রণ আর কতদিন রাজনীতিক বা রাষ্ট্রনায়কদের মুখের বুলি হয়ে থাকবে? না। বৃথাই হিন্দুরা বলে গঙ্গা আমাদের মা!
ছবি: The Hindu